ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ
সারাবিশ্বের মতো ১৭ মে দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন লীগ ও ইন্টারন্যাশনাল হাইপারটেনশন সোসাইটি এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে, ‘সঠিকভাবে রক্তচাপ মাপুন, নিয়ন্ত্রণে রাখুন এবং দীর্ঘজীবী হোন’।
অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ খুবই জরুরী। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন কি?
স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো সেই বল, যার সাহায্যে রক্ত শরীরের একস্থান থেকে অন্যস্থানে পৌঁছায়। হৃদপিন্ডের পাম্পিং ক্রিয়ার মাধ্যমে রক্তচাপ তৈরী হয়। রক্ত চাপের কোন একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সাথে সাথে একেক জনের রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের বেলায় বিভিন্ন সময়ে রক্তচাপও কম বেশী হতে পারে। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, অধিক পরিশ্রম, কম ঘুম ও অতিরিক্ত ব্যয়ামের ফলে রক্তচাপ বাড়তে পারে। ঘুম ভালো হলে এবং বিশ্রাম নিলে রক্তচাপ কমে যায়। রক্তচাপের এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। সাধারণত বয়স যত কম, রক্তচাপও তত কম হয়। যদি কারও রক্তচাপ নরমাল মাত্রার চাইতে বেশী হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রাম কালীনও বেশী থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
রক্তচাপ কত প্রকার:
সাধারণত দুই ধরনের, সিস্টোলিক ও ডায়াস্টলিক। নরমাল সিস্টোলিক ১০০ থেকে ১৪০ এবং ডায়াস্টলিক ৬০ থেকে ৯০ মি.মি মার্কারি। কারও ব্লাড প্রেশার যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। তবে বয়স ভেদে তারতম্য হতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কি আসলেই কোন জটিল ব্যাধি?
উচ্চ রক্তচাপ ভয়ংকর পরিনতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোন প্রাথমিক লক্ষ্মণ দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচাইতে খারাপ দিক। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর বেলায় কোন লক্ষ্মণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চরক্তচাপ কে বলা হয় “নীরব ঘাতক”। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কি কি জটিলতা হতে পারে?
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ন ৪টি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃদপিন্ড, কিডনী, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংশপেশী দুর্বল হয়ে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট এ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারনে কিডনী বিকল হয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে, যার অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ। এছাড়া মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে এবং চোখের রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে।
কি কি কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়?
শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর উচ্চ রক্তচাপের কোন নির্দিস্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারী বা এসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। সাধারণত বয়স্ক মানুষের উচ্চ রক্তচাপ বেশী হয়ে থাকে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চ রক্তচাপের ঝুকি বাড়ায়, যেমন:
* বংশানুক্রমিক: উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে।
* ধুমপান: ধুমপায়ীদের শরীরে তামাকের নানা রকম বিষাক্ত পদার্থের প্রতিক্রিয়ায় উচ্চ রক্তচাপসহ ধমনী, শিরার নানা রকম রোগ ও হৃদরোগ দেখা দিতে পারে। তামাক, জর্দা, গুল ব্যবহারে একই সমস্যা হতে পারে।
* অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ: খাবার লবণে সোডিয়াম থাকে যা রক্তের জলীয় অংশ বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্তের আয়তন বেড়ে যায় এবং রক্ত চাপও বেড়ে যায়।
* অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা: যথেষ্ঠ পরিমানে ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম না করলে শরীরে ওজন বেড়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং এর ফলে অধিক ওজন সম্পন্ন লোকদের উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকে।
* অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন এবং ডুবা তেলে ভাজা খাবার খেলে ওজন বাড়বে। কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেষ্টরল বেড়ে যায়। রক্তে অতিরিক্ত কোলেষ্টরল হলে রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে।
* অতিরিক্ত মদ্যপান: যারা নিয়মিত অত্যাধিক পরিমাণে মদ্যপান করে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ বেশী হয়। অ্যালকোহলে অতিরিক্ত ক্যালরী থাকে, এর ফলে ওজন বেড়ে যায় এবং এতে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
* ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস রোগীদের অথারোসক্লেরোসিস বেশী হয়। ফলে বয়সের সাথে সাথে ডায়াবেটিস রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। এছাড়া তাদের অন্ধত্ব ও কিডনীর নানা রকম রোগ হতে পারে।
*অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা: অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারনেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। যদি এই মানসিক চাপ অব্যাহত থাকে এবং রোগী ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপের সংঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারেন, তবে এই উচ্চ রক্তচাপ স্থায়ী রূপ নিতে পারে।
অন্যান্য কারণসমূহ:
কিছু কিছু অঙ্গ আক্রান্ত হলে রোগের কারনে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারী হাইপারটেনশন।
এই কারণ গুলির মধ্যে কয়েকটি হলো:
* কিডনীর রোগ।
* অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারী গ্রন্থির টিউমার।
* ধমনীর বংশগত রোগ।
* গর্ভধারন অবস্থায় এ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি এ্যাকলাম্পসিয়া হলে।
* অনেকদিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রনের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড গ্রহণ এবং ব্যাথা নিরামক কিছু কিছু ঔষধ সেবন করলে।
উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমাতে কি করা উচিত?
জীবন যাত্রার পরিবর্তন এনে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বংশগতভাবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা কমানো সম্ভব না। তবে এরকম ক্ষেত্রে যে সব উপাদান নিয়ন্ত্রন করা যায়, সেগুলোর ব্যাপাবে বেশী মনোযোগী হওয়া উচিৎ।
* অতিরিক্ত ওজন কমাতে হবে।
* খাওয়া দাওয়া নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
* নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম করতে হবে।
* খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা: কম চর্বি ও কম কোলেষ্টেরল যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাশি বা গরু গোস্ত , কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননী তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সুর্য্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশী আশযুক্ত খাবার গ্রহন করা ভালো। আটার রুটি এবং সুজী জাতীয় খাবার পরিমান মত খাওয়া ভালো।
* লবণ নিয়ন্ত্রণ: তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবনের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।
* মদ্যপান: অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে।
* নিয়মিত ব্যায়াম: সকাল-সন্ধ্যা হাটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিড়ি ব্যবহার ইত্যাদি।
* ধুমপান বর্জন: ধুমপান অবশ্যই বর্জনীয়। ধুমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দুরে থাকুন। তামাক পাতা, জর্দ্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।
* ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
* মানসিক ও শারীরিক চাপ সামলাতে হবে: নিয়মিত বিশ্রাম, সময় মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের সখের কাজ করা, নিজ ধর্মের চর্চা করা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি বেশী হবে।
* রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা: নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিৎ। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রন করা যায় এবং জটিলতা হতে রক্ষা পাওয়া যায়।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে?
উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রন করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে। অনেক রোগী কিছুদিন ঔষধ খাবার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে আসলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ঔষধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পুর্ন ভুল। কোনক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। অনেকেই আবার উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ঔষুধ খেতে অনিহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারো কারো ধারণা একবার ওষুধ খেলে তা আর বন্ধ করা যাবে না। আবার কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবন প্রবাহে কোন সমস্যা করছে না বা রোগের কোন লক্ষন নাই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না। তাদের ধারণা ভালইতো আছি, ঔষধের কি দরকার? এই ধারণাগুলো সম্পূর্ন ভুল। এই ধরনের রোগীরাই হঠাৎ করে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমন কি মৃত্যুও হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদেরকে অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত সারা জীবন ঔষধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।
লেখক- ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক; প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক
Discussion about this post