হার্টবিট ডেস্ক
অভাবী পরিবারে জন্ম শিশু তানিমের। জন্ম থেকে ঠিকমত প্রস্রাব হয় না। মলের সাথে পানির মত তরল বের হয়। সবসময় পেট ফুলে থাকে। দারিদ্র্যের অভিশাপের সাথে লড়াই করেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায় তার বাবা-মা। ৬ মাস বয়সে ধরা পড়ে তানিম ‘মেল ক্লোয়েকা’ নামক জটিল জন্মগত ত্রুটিতে আক্রান্ত।
রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, তার প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা একটি। এখানে-সেখানে ছুটোছুটির পর অবশেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু সার্জারী বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ও শিশু সার্জারি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাহমিনা বানুর খোঁজ পায় তানিমের পরিবার। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তিন দফায় সার্জারি (অস্ত্রোপচার) হয় শিশু তানিমের। বিনা খরচেই এ অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেন ডা. তাহমিনা বানু ও তাঁর টিম।
সফল অস্ত্রোপচারের পর তানিম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। বর্তমানে সাড়ে সাত বছরের তানিম স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুকেও এভাবে অপমৃত্যু অথবা দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব বলে জানান ডা. তাহমিনা বানু। তিনি বলেন, শিশু তানিমের জন্মগত যে রোগটি ধরা পড়েছে, সেটি মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। কিন্তু ছেলে শিশুর ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এটি-ই বোধহয় সর্বপ্রথম রিপোর্টেড। অর্থাৎ এর আগে কোন ছেলে শিশুর জন্মগত এরকম ত্রুটি বা রোগে আক্রান্ত হিসেবে আমরা তথ্য পাইনি।
আজ ৩ মার্চ বিশ্ব জন্মগত ত্রুটি দিবস। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে চট্টগ্রামেও।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের প্রায় ৪৫ শতাংশই আসে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত শিশু সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া ১২ হাজার ৬৮৯ জনের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে আসে।
গবেষণায় দেখা যায়, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুদের ৯৪ শতাংশ মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারের। জন্মগত ত্রুটিযুক্ত ছেলেশিশুর সংখ্যা মেয়েদের প্রায় দ্বিগুণ। চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এ ধরনের শিশুদের মধ্যে মারা গেছে ২২৫ জন। এই সংখ্যা চার বছরে চিকিৎসা নিতে আসা মোট শিশুর ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নবজাতকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে জন্মগত ত্রুটিকে ৪ নম্বর সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বে প্রতি ১০০ নবজাতকের মধ্যে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মায়। তবে বাংলাদেশে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে কত শিশু জন্ম নেয়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সবচেয়ে কম জন্মগত ত্রুটি নিয়ে শিশু জন্মায় জাপানে, ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ৫০ শতাংশ জন্মগত ত্রুটির কোনো ব্যাখ্যা নেই।
চিকিৎসকেরা বলছেন, গর্ভকালীন অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া, অসচেতনতা, গর্ভাবস্থায় ছোটখাটো সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধ সেবন, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে, পরিবেশ দূষণ, বংশগত সমস্যা, তেজস্ক্রিয়তা, হাসপাতাল কিংবা মাতৃসদনের বাইরে সন্তান প্রসব মূলত এসব কারণে শিশুর শরীরে জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
অধ্যাপক তাহমিনা বানু বলেন, জন্মগত ত্রুটি নিয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে বেশির ভাগই খাদ্যনালি-সংক্রান্ত জটিলতা যেমন হার্নিয়া, কিডনি ও মূত্রনালির সমস্যায় আক্রান্ত। এসব ক্ষেত্রে যত সম্ভব তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। সঠিক সময়ে নির্ণয় করা সম্ভব হলে চিকিৎসার মাধ্যমে ৭০ শতাংশ জন্মগত ত্রুটি সারিয়ে তোলা যায়।
চিকিৎসকেরা জানান, কিছু জন্মগত ত্রুটি যেমন কানের ফুটো না থাকা, ঠোঁট ও তালু কাটা, হাত ও পায়ের সমস্যা, পায়ুপথ ও মূত্রনালির রাস্তা বন্ধ থাকা এসব সমস্যা বাবা-মায়েরা দেখলেই বুঝতে পারবেন। খাওয়ার পর বারবার বমি করা, শ্বাসকষ্ট হওয়া, পেট ফুলে যাওয়া, নীল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে শিশুর সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসায় এর বড় একটি অংশ ভালো হয়।
জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুর চিকিৎসার পাশাপাশি এ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণা করে আসছে চিটাগং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড সার্জারি (ক্রিকস)। গবেষণার পাশাপাশি জন্মগত ত্রুটিযুক্ত শিশুদের চিকিৎসা এবং প্রয়োজনে অস্ত্রোপচারও করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিনা খরচেই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আস্থা তৈরি করার অন্যতম হাতিয়ার হলো প্রাথমিক সংশোধনী সার্জারি। এ উদ্দেশ্য প্রচারে সরকার, সুশীল সমাজ, স্থানীয় সমপ্রদায়, গ্লোবাল ফোরাম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এতে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে বলে অভিমত অধাপক ডা. তাহমিনা বানুর।
Discussion about this post