হার্টবিট ডেস্ক
শীত আসছে। এ সময় শিশুকে কীভাবে সুস্থ রাখা সম্ভব, কী করলে রোগব্যাধির আক্রমণ কম হবে তা সবারই জানা দরকার। শীতের কারণে সাধারণ সর্দি-কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি বাড়ে, ব্রংকাইটিস হয়, ঋতু পরিবর্তনের জন্য কিছু ভাইরাস জ্বরও হচ্ছে। এ সময় টনসিল ফুলে যায়, সাইনোসাইটিস হয়। শীতকালে আর্দ্রতা কমে যায়, বাতাসে ধুলাবালি বেশি ওড়ে, তাই সর্দি-কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস ও ব্রংকিউলাইটিসের প্রকোপ বেশি হয়। ত্বকের শুষ্কতা বাড়ার জন্য বিভিন্ন চর্মরোগ ও অ্যালার্জি হয়। শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য শীতের প্রস্তুতি ও চিকিৎসা নিয়ে লিখেছেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন।
পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস হলো শীতকাল অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। কিন্তু নভেম্বর থেকেই হালকা শীতের আমেজ অনুভব করা যায়। ঋতু পরিবর্তনের সময় রোগব্যাধির প্রকোপ স্বভাবতই বেড়ে যায়। ছোট শিশু ও বয়স্ক, যাদের বয়স ৬০-৭০ বছর, তাদের রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত করে। শিশু ও বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার ফলে তারা আক্রান্ত হন বেশি। শীতের শুরুতে এবং শীত চলে যাওয়ার সময়ে তাপমাত্রা পরিবর্তনের জন্য এর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। প্রায়ই দেখা যায়, দুই-তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে পানি ঝরে। তাই এ সময়টাতে সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।
করণীয়
শীত থেকে বাঁচতে হলে সামর্থ্য অনুযায়ী যথাসম্ভব গরম কাপড় পরতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের গরম কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকতে বা টুপি পরাতে হবে। কানে শীত বেশি লাগে, তাই কান ঢেকে রাখতে হবে। ধুলাবালি থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। যাদের সুযোগ আছে তারা উষ্ণ গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন। অথবা দুপুরের দিকে গোসল করতে হবে, তখন পানিতে ঠান্ডা কম থাকে। শোয়ার সময় লেপ বা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে ঠান্ডা না লাগে। আবার অতিরিক্ত গরম কাপড়ের জন্য যাতে ঘেমে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, শিশুরা যাতে ধুলাবালিতে খেলতে না যায়, আইসক্রিমসহ অন্যান্য ঠান্ডা পানীয় বা খাবার যেন যেন না খায়। কুসুম কুসুম গরম পানি খেতে হবে।
ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার না খেয়ে, তাজা রান্না করা গরম খাবার খাওয়াই ভালো। ধূলিকণা থেকে বাঁচতে হলে মাস্ক পরতে হবে, যতটা সম্ভব কম জনসমাগম ও ভিড়ের জায়গা যেমন শপিংমল, হাটবাজার বা বিয়েবাড়িতে শিশুদের না নেওয়াই ভালো। রাস্তা-ঘাটে পানি ছিটাতে হবে যাতে ধুলাবালি ও জীবাণু অনেক কমে যাবে।
নবজাতক শিশুর যত্ন
নবজাতকের তাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খুবই কম, তাই অল্প শীতেই তারা কাবু হয়ে যায়। যে বাচ্চা পূর্ণ ৩৭ সপ্তাহ মাতৃগর্ভে কাটিয়ে জন্ম নিয়েছে তার ক্ষেত্রে জটিলতা কম। সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। শিশু মায়ের পেটে উষ্ণ তাপমাত্রায় অবস্থান করে। তাই পৃথিবীর তাপমাত্রায় সে শীত অনুভব করে। তা ছাড়া শিশুর শরীরে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরোপুরি তৈরি হতেও সময় লাগে। শিশুকে উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখতে হবে। যদি ঘরের তাপমাত্রা ২৫ সেলসিয়াস হয়, তবে সুতির কাপড় পরিয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে রাখুন। এ মাত্রার নিচে হলে সোয়েটার ব্যবহার করতে হবে। বাচ্চা বুকের দুধ খাওয়ার সময় সাধারণত ঘেমে যায়। তাই ওই সময় সোয়েটার আলগা করে দিন। শীতে নবজাতককে অবশ্যই হাতমোজা, পা’মোজা ও কানটুপি পরাতে হবে।
মনে রাখবেন
* বাচ্চাকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়ান। বুকের দুধে রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। ফলে শিশু সহজে ঠান্ডা, কাশি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয় না।
* দিনে ঘরের জানালা খুলে রোদ ও নির্মল বাতাস ঘরে ঢুকতে দেওয়া ভালো, ঠান্ডা বাতাস এলেও ক্ষতি নেই। ঘরের মধ্যে ভিজা কাপড় না শুকিয়ে অবশ্যই রোদে শুকাতে হবে।
* শীতকালে বাচ্চাকে দোলনায় বা আলাদা মশারির নিচে না রেখে মায়ের কোলঘেঁষে শোয়াতে হবে। এতে বাচ্চা উষ্ণ থাকবে, মায়ের সঙ্গে আন্তরিকতা বাড়বে ও বুকের দুধ খাওয়াতে সুবিধা হবে।
* যদি পরিবারের কোনো সদস্যের বা কোনো আত্মীয়ের সর্দি, কাশি, ভাইরাল জ্বর ইত্যাদি থাকে, তবে তারা মা ও নবজাতক শিশুর কাছে আসা থেকে বিরত থাকতে হবে।
* শিশুকে শীতকালে ঘরের বাইরে নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। রোদে দিতে হলে জানালার পাশে বা ঘরের বারান্দা থেকে রোদ লাগান।
* নবজাতক শিশুকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে গোসল করানোর দরকার নেই। জন্মের ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত গোসল করানো উচিত নয়। এর মধ্যে শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা গড়ে উঠবে।
* বাচ্চার নাভি না শুকানো পর্যন্ত তাকে গোসল না করানোই ভালো। সপ্তাহে দুদিন গোসল করানোই যথেষ্ট। গোসলের আগে ঘরের দরজা-জানালা লাগিয়ে নিন। গোসলের জন্য প্রয়োজনীয় ঈষদুষ্ণ পানি (৪৫ সে.), নরম কাপড় বা স্পঞ্জ, তোয়ালে, ভ্যাসলিন, ডায়াপার ইত্যাদি সব হাতের কাছে গুছিয়ে নিয়ে গোসল করাতে বসুন।
* নবজাতক শিশুর সামান্য কাশি বা হাঁচিও কিন্তু সন্দেহজনক। তাই কাশি, শব্দ করে শ্বাস টানা, দুধ টেনে খেতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট বা পাঁজর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেঁকে যেতে থাকলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
যা করা যাবে না
* শীতকালে নবজাতকের মাথা কামানো যাবে না। গর্ভকালীন চুল অপবিত্র বলে অনেকে জন্মের পর চুল কামান। এর কোনো প্রয়োজন নেই। চুল মাথার তাপমাত্রা ধরে রাখে, চুল কামিয়ে দিলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। শিশুর নাক বা মুখের ওপর কাপড়, লেপ, কম্বল ইত্যাদি দেবেন না।
* ঘরে কয়লা ও তুষের আগুন রাখবেন না যেন, এতে শিশুর ক্ষতি হয়।
* জন্মের পর ত্বকে এক ধরনের সাদা আবরণ দেখা যায়। অনেকেই এটি নোংরা ভেবে মুছে দেন বা গোসল করিয়ে ধুয়ে দেন। আসলে কিন্তু এ আবরণ নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখে, জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং ত্বককে সুরক্ষা দেয়। তাই এটি সঙ্গে সঙ্গে মোছা উচিত নয়।
* নাভিতে কিছু লাগানো নিষেধ। শীতে অনেকে বাচ্চার নাভিতে তেল মেখে রোদে শুইয়ে রাখেন। এতে নাভিতে সংক্রমণ হতে পারে।
* ডায়াপার ছয় ঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই রাখা উচিত না। ডায়াপার থেকে র্যাশ হতে পারে, তাই আগে থেকে ভেসলিন বা জিংকসমৃদ্ধ ক্রিম লাগাতে হবে।
দেড় মাস থেকে এক বছর বয়সি শিশুর যত্ন
* শিশুকে প্রয়োজন অনুযায়ী উষ্ণ রাখুন। ঠান্ডা পরিবেশে রাখা যাবে না। স্যাঁতসেঁতে ঘরেও তাকে রাখা ঠিক হবে না। বাচ্চাকে বুকের দুধ নিয়মিত খাওয়ান। ছয় মাসের বেশি হলে বাচ্চাকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার দিন। খিচুড়িতে ডিমের সাদা অংশ, লাল শাক, পালং শাক অল্প করে দিতে পারেন। লেবুর রস দেবেন, কমলার রস খাওয়াবেন। এতে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়বে।
* যেসব বাচ্চা হামাগুড়ি দেয়, দেখবেন তারা যেন ঠান্ডা মেঝেতে হামাগুড়ি না দেয়। তবে কার্পেট ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ কার্পেটের রোয়া থেকে বা ধুলো থেকে অ্যালার্জি হয়। তাই মাদুর বা ম্যাট ব্যবহার করা ভালো।
এক থেকে ছয় বছর বয়সের শিশুর যত্ন
এ বয়সে শিশুরা অনেক খেলাধুলা ও দৌড়াদৌড়ি করে থাকে, তাই খুব বেশি গরম ও ভারী কাপড় পরার প্রয়োজন হয় না। সকালে স্কুলে যাওয়া ও বিকালে খেলতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত উষ্ণতা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা স্কুলে পরস্পরের মাধ্যমে সর্দি-কাশি, ফ্লুসহ শীতকালের কিছু ছোঁয়াচে চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। এ ব্যাপারে শিশুকে স্বাস্থ্যবিধি শেখাতে হবে। নিয়মিত লোশন লাগাতে হবে যেন ত্বক শুষ্ক হয়ে না যায়। শীতকালীন শাকসবজি ও ফল বেশি করে খেতে দিতে হবে।
Discussion about this post