হার্টবিট ডেস্ক
পৃথিবীব্যাপী অসংক্রামক ব্যাধি দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাইগ্রেন ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধি এখন মারণ ঘাতক। এই অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ। আর এ রোগের ঝুঁকিমুক্ত মাত্র ৩ শতাংশ মানুষ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ি, বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৬০ ভাগের জন্য দায়ি অসংক্রামক রোগ। সেই সূত্রে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অসংক্রামক। এর মধ্যে কিডনী, ক্যান্সার, যকৃতে প্রদাহ, ফুসফুস, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীই বেশি।
অসংক্রামক রোগ কি?
যেসব রোগ জীবাণু দিয়ে হয় না, যে রোগগুলো একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না; অর্থাৎ ছোঁয়াচে না তাদের অসংক্রামক ব্যাধি (Noncommunicable diseases, or NCDs) বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত শারীরিক অবস্থা বা রোগ যেটা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না।
কিভাবে হতে পারে অসংক্রামক ব্যাধি?
অসংক্রামক ব্যাধি আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের জোরালো পারিবারিক ইতিহাসই থাকে। এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান (Environmental factors) যেমন- পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। এই দুয়ে মিলে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এ ধরনের রোগে। ফলে সারা পৃথিবীজুড়ে অনেক মানুষ কম বয়সে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, বাড়ছেপারিবারিক ব্যয়।
অসংক্রামক ব্যাধির প্রকারভেদ
অসংক্রামক রোগের তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এই রোগগুলো হচ্ছে হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য হৃদ্রোগ, স্ট্রোক (মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ), ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি রোগ, শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ও মানসিক রোগ
সাধারণত চার ধরনের অসংক্রামক ব্যাধি আছে। সেগুলো হল- হৃদরোগ (cardiovascular diseases) যেমন- হৃদযন্ত্রের বৈকল্য (heart attacks) এবং উচ্চ রক্তচাপ জনিত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (stroke); ক্যান্সার, দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ (chronic respiratory diseases) যেমন- দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের বিশেষত ফুসফুসের বাধাগ্রস্থতার রোগ এবং হাঁপানি এবং বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস।
অসংক্রামক রোগে বাড়ছে মৃত্যু/পরিসংখ্যান
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনার বছরে (২০২০) দেশে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু সাড়ে ২২ ভাগ বেড়েছে। ব্রেইন ক্যান্সারে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ ভাগ, ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। কিডনি রোগে মৃত্যুহার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আত্মহত্যাও।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে।
বিবিএস জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে হৃদরোগ, মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্র ও কিডনিসহ অসংক্রামক রোগে মানুষের মৃত্যু বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ২০১৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৫০২ জন, ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনের। ব্লাড ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২০ থেকে এক বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪৭১ জনে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে যে প্রাক্কলন তুলে ধরা হয় তাতে দেখা যায়, অসংক্রামক রোগে বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ তালিকায় রয়েছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডায়বেটিস, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ আরও কিছু রোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া এবং কায়িক পরিশ্রম কম করায় হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত এক বছরে করোনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ২৪৮ জন। আত্মহত্যায় মারা গেছে ১১ হাজার ২৫৯ জন। সে হিসেবে করোনার চেয়ে হার্ট অ্যাটাক বা ক্যান্সারে মৃত্যু অনেক বেশি লক্ষ্য করা গেছে। কিডনি রোগে ২০১৯ সালে ১০ হাজার ৬০০ মানুষ মারা গেলেও ২০২০ সালে মারা গেছে ২৮ হাজার মানুষ। লিভার ক্যান্সারে মৃত্যু ২১ হাজার ৩০০ থেকে বেড়ে ২৯ হাজার ৮৫০ হয়েছে।
করোনার সময়ে আত্মহত্যাও বেড়েছে। ২০১৯ সালে দেশে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করেছিল। করোনার বছরে আত্মহত্যা করেছে ১১ হাজার ২৫৯ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালে দেশে ডায়বেটিকসে মারা গেছেন ২২ হাজার ৩০ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার। ২০২০ সালে নাক-কান-গলার অসুখে মারা গেছে ২ হাজার ৮৮০ জন, যা আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। তবে চিকনগুনিয়া, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার অর্ধেকের বেশি কমেছে।
জন্ডিসে মৃত্যুর হার দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৯ সালে জন্ডিসে ৫ হাজার ৫০৭ জন মারা গেলেও ২০২০ সালে মারা গেছে ১০ হাজার ৯৯৭ জন। প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনার বছরে মাদক গ্রহণের ফলে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। চর্মরোগে মৃত্যু ১৩১ থেকে বেড়ে ১৫৭১ হয়েছে। নারীদের জরায়ুর ক্যান্সারে মৃত্যু দ্বিগুণ বেড়ে ৪ হাজার ৩২০ হয়েছে।
বিবিএসের হিসাবে দেশে ২০২০ সালে ৭৫ রকমের রোগ ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছে ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২৫৩ জন। অর্থাৎ গড়ে দুই হাজার ৩৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আগের বছরের চেয়েও ২০২০ সালে মৃত্যু বেড়েছে তিন শতাংশ। তবে এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত হয়ে গত দুই বছরে দেশে একজনেরও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে বিবিএস।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী ২০২০ সালে করোনায় মারা গেছে ৮ হাজার ২৪৮ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন মৃত্যুহার ২২ দশমিক ৬০। আর দেশে বিভিন্ন রোগে মৃত্যু হচ্ছে ২ হাজার ৩৪০ জনের।
সাবধানতা ও প্রতিকার
যাদের পরিবারে অসংক্রামক ব্যাধি জনিত রোগ আছে, তাদের উচিত হবে তাঁদের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া। শৈশব থেকেই এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের দিকে মনোযোগী হতে হবে। ওজন বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড বা কোমল পানীয় গ্রহণ, ধূমপান—ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। ছেলেবেলা থেকে কায়িক শ্রম, ব্যায়াম ও খেলাধুলায় উৎসাহী করতে হবে এদের। কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে বেশি।
ইদানীং বলা হচ্ছে- স্তন ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসারসহ কিছু ক্যানসারেরও পারিবারিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। আর স্থূলতা, ওজনাধিক্য প্রতিরোধ করা গেলে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে এ ধরনের ক্যানসারকেও প্রতিরোধ করা যায়। পরিবারে মা-বাবার ডায়াবেটিস থাকলে তাঁদের তরুণী কন্যাসন্তানের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের পরিবারের মেয়েদেরও হতে হবে সচেতন। মুটিয়ে যাওয়া এবং কায়িক শ্রমের অভাব এই ঝুঁকি বাড়াবে। তাই তাঁদের উচিত সন্তান নেওয়ার আগেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা ও খাদ্যাভ্যাস পাল্টানো। পাশাপাশি নিয়মিত নিজেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। ৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করা, চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করা, রক্তচাপ মাপা উচিত। মাত্রা বর্ডার লাইনে হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কি না দেখুন। এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের সামান্য উপসর্গকেও উপেক্ষা করা যাবে না। মেয়েরা গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই রক্তের শর্করা দেখে নেবেন। থাইরয়েডের সমস্যা পরিবারে থেকে থাকলে তা-ও দেখে নেওয়া ভালো। মা-খালাদের স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে নিজের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখুন। প্রয়োজনে আলট্রাসনোগ্রাম বা ম্যামোগ্রাফি করান চিকিৎসকের পরামর্শে। কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলুন। লাল মাংস (গরু-খাসি) কম খাবেন, বেশি খাবেন আঁশযুক্ত খাবার ও ফলমূল। এ ছাড়া কিছু জিনগত রোগ আছে, যেমন থ্যালাসেমিয়ার জিন বংশগতভাবে সন্তানেরা পেয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই তার যথাযথ স্ক্রিনিং, রোগ নির্ণয় প্রয়োজন। বড় হলে প্রয়োজনে যেন ব্যবস্থা নেওয়া যায় এ জন্য সচেতন হতে হবে। এ ধরনের পরিবারে নিজেদের মধ্যে বিয়ে না হওয়াই ভালো। ‘কাজিন ম্যারেজ’ পরবর্তী প্রজন্মের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে। এমনকি বিয়েশাদির সময় জীবনসঙ্গীও এ ধরনের জিনের বাহক কি না তা জেনে নেওয়া ভালো।
প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ
অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গৃহীত ‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫’-এর দুই ধাপের প্রথম ধাপ শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার ফলে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার কতটুকু কমানো সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৮ অনুযায়ী, অসংক্রামক রোগের কারণে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি এক লাখে মারা গেছে ৩৬৯ দশমিক ৭৮ জন। এই মৃত্যুহার কমাতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৩ অর্জন অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হলো ২০২৫ সালের মধ্যে ৩০-৭০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অসংক্রামক রোগজনিত অকালমৃত্যুর হার ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনা। এই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রোগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধের দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে। এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়াও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্য ক্যাডারদের অসংক্রামক রোগ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ, টিকাদান কর্মসূচি, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবাসহ নিয়মিত অন্য সব সেবার সঙ্গেই অসংক্রামক রোগের এলাকাভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
Discussion about this post