ডা. মো. ফজলে রাব্বি চৌধুরী, সহকারী অধ্যাপক
ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগ, বিএসএমএমইউ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঈদুল আজহার পর থেকে সারাদেশে চলমান লকডাউনে বরাবরের মতো সাধারণ মানুষকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে দেশে প্রকৃত লকডাউন বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও এবারের লকডাউন অনেকটা কার্যকর। তবে অধিকতর ফল পেতে চাইলে এ লকডাউন প্রলম্বিত করতে হবে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দেশে করোনার যে তৃতীয় ঢেউ চলছে, ঢাকায় এর প্রকোপ অপেক্ষাকৃত কম। এর আঘাতটা বেশি লেগেছে ঢাকার বাইরে। সুতরাং শুধুমাত্র ঢাকা সুরক্ষিত রাখলেই হবে না। এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাজশাহী, খুলনা ও ময়মনসিংহসহ ঢাকার বাইরে প্রতিটি অঞ্চলে লকডাউন কঠোরভাবে পালন করতে হবে। সর্বত্র সংক্রমণের চক্র ভেঙে দিতে হবে। তবেই পুরো দেশব্যাপী এই লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে।
কোডিভ থেকে সুরক্ষার দুটি অস্ত্র
এ ছাড়া কোডিভ থেকে সুরক্ষায় আমাদের হাতে দুটি অস্ত্র রয়েছে। একটি মাস্ক, আরেকটি ভ্যাকসিন। লকডাউনে জীবিকা বা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে কাউকে যদি বাইরে বের হতে হয়, তাহলে সর্বাবস্থায় মাস্ক পরে বের হতে হবে। এটা এখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, দুই প্রান্তে মাস্ক পরা থাকলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি মাত্র দুই শতাংশ বা তার চেয়েও কম থাকে। এমনকি দুইজনের একজন কিংবা উভয়ের যদি কাশিও থাকে।
আমাদের ভ্যাকসিনের সংকট রয়েছে। রাষ্ট্র চায়, ১৩-১৪ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন প্রদান করতে। কিন্তু আমাদের হাতে আছে দুই-তিন কোটি ভ্যাকসিন। সুতরাং কোভিডে অধিকমাত্রায় মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বয়স্কদের আগে টিকাদান নিশ্চিত করতে হবে। তাদেরকে আগে সুরক্ষা বলয়ে নিয়ে আসতে হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে যুবক, তরুণদের।
এটা প্রমাণিত যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) কর্তৃক স্বীকৃত যে কোনো ভ্যাকসিনের দুই ডোজ গ্রহণকারী ব্যক্তি আক্রান্ত হলেও করোনায় মৃত্যুর আশঙ্কা ১ শতাংশেরও কম। সুতরাং দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষ অন্তত কোভিডে মারা যাবে না—এ ব্যাপারে আমরা মোটা দাগে মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারি। সুতরাং যেখানে যে ভ্যাকসিনই পাবেন, সেটাই গ্রহণ করুন। কারণ প্রতিটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাই কাছাকাছি। প্রতিটি ভ্যাকসিনেই ৭০-৯০ শতাংশ কার্যকারিতা ক্ষমতা রয়েছে। আমাদের দেশে সচরাচর পাওয়া যাচ্ছে, যেমন: অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা, সিনোফার্মা, ফাইজার, মডার্না—প্রতিটিই করোনা থেকে সুরক্ষায় কার্যকর।
তরুণদের অসতর্কতায় ঘটবে পারে বিপর্যয়
এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তরুণ হওয়ায় হয় তো আক্রান্ত হলে তার মধ্যে করোনার লক্ষণ কম প্রকাশ পাচ্ছে, অথবা তারা বুঝতেও পারছে না। তিন-চার দিনের ব্যবধানে আবার ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার দ্বারা পরিবারের, পাড়া-প্রতিবেশীর বয়োবৃদ্ধ কেউ আক্রান্ত হলে তিনি মারাও যেতে পারেন। সুতরাং তাদের অনেক বেশি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্র, গণমাধ্যম মাস্কসহ স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। আমি মনে করি, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তারও এ ব্যাপারে একটি দায়িত্ব রয়েছে।
বাড়াতে হবে নমুনা পরীক্ষা
নমুনা পরীক্ষায় শুরুতে বাংলাদেশে ব্যাপক ঘাটতি ছিল। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট আসতেও বেশ সময় লেগেছে। পরবর্তীতে দ্রুততার সঙ্গে এর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এখন ৪০-৫০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হায়দ্রাবাদ বাংলাদেশ থেকে তিনগুণ ছোট। সেখানে মেডিসিনের ইনফেকশাস ডিজিজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পেরেছি, সেখানে দিনে ৬৫-৭০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অথচ আমাদের দেশে র্যাপিড অ্যান্টিজেনসহ ৩৫-৪০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করানো হচ্ছে। শুধু পিসিআর করে এ সংকট সামাল দেওয়া যাবে না। সুতরাং পরীক্ষার সক্ষমতা অনেক গুণ বৃদ্ধি করতে হবে। এটা তৃণমূলের মানুষের দোঁড়গোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। যেন ইউনিয়ন সাবসেন্টারে এসেও র্যাপিড টেস্ট করতে পারে। এজন্য পরীক্ষার সব রকম পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট, লুপ অ্যামপ্লিফাই টেস্ট (ল্যাম্প), জিন এক্সপার্ট টেস্ট। সব ধরনের অস্ত্রই প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে দৈনিক অন্তত এক লাখ টেস্ট করতে পারলে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
Discussion about this post