প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক থাইরয়েড গ্রন্থির অবস্থান ও শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া সম্পর্কে। থাইরয়েড শব্দটির উৎস হল থাইরয়েড নামে একটি গ্রীকশব্দ থেকে যার অর্থ হল শিল্ড বা বর্ম। আকৃতিতে বর্ম সদৃশ হওয়ায় অথবা বর্মের মতো শরীরকে রক্ষা করবার জন্যই হয়তো এই নামকরণ। এই থাইরয়েড গ্রন্থি আমাদের গলায় শ্বাসনালী বা ট্রাকিয়ার দু’পাশে অবস্থিত। আরও সঠিক ভাবে বললে শ্বাসনালীর দ্বিতীয় এবং চতুর্থ তরুণাস্থি বলয়ের দু’পাশে গ্রন্থিটি অবস্থিত। এর ওজন প্রায় ১৫-২০ গ্রাম। এই গ্রন্থির কাজ হল প্রধানত জল বা খাদ্যজল লবণ বা খাদ্যবস্ত্তু থেকে আয়োডিন সংগ্রহ করা এবং বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় টাইরোসিন নামক একটি অবশ্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে টি-ফোর বা থাইরক্সিন এবং টি-থ্রি নামে দু’টো হরমোন প্রস্ত্তুত করা যা আমাদের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে জরুরি।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে দৈহিক ১০০ থেকে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম আয়োডিন লবণ প্রয়োজন হয়।
গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদায়ী মায়ের ক্ষেত্রে আয়োডিন লবণ প্রয়োজন হয় একটু বেশি মাত্রায়। টি-থ্রি এবং টি-ফোর নামকরণের উদ্দেশ্য হল ওই হরমোনের একটি অনুতে যথাক্রমে তিন বা চারটি আয়োডিন পরমাণু থাকে। অন্যদিকে মস্তিষ্কের মধ্যে অবস্থিত পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত বিশেষ হরমোনগুলোর মধ্যে একটি হরমোন থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টি.এস.এইচ., থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি, কার্যকারিতা ও হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ কমে গেলে পিটুইটারি গ্রন্থির থেকে নিঃসৃত টি.এস.এইচ বেড়ে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ বাড়াতে চেষ্টা করে। উল্টোভাবে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোন নিঃসরণ বেড়ে গেলে টি.এস.এইচ, নিঃসরণ কমে যায়। এই শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতিটিকে বলা হয় নেগেটিভ ফিডব্যাক, যার মাধ্যমে শরীরে টি-থ্রি এবং টি-ফোর হরমোনের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সীমার অবস্থান করে।
স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যে আয়োডিন লবণের অভাব হলে থাইরয়েড গ্রন্থিটি ঠিকমতো কাজ করতে না পারায় এবং প্রয়োজন মতো হরমোন সরবরাহের তাগিদে আকৃতিতে বড় হয়ে যায়। এই রোগের বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে হতে পারে যাদের বলা হয় আয়োডিন ডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডার। এগুলো অবশ্যই নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ এবং বিশেষভাবে জরুরি কারণ নিয়ন্ত্রণে বেশি দেরি হলে তা থেকে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভারতবর্ষের বেশে কিছু এলাকায়, বিশেষত পাহাড়ী অঞ্চলে পানীয় জলে আয়োডিন লবণের অভাব থাকায় এই রোগ এদেশে কিছুদিন আগেও একটি সমস্যা ছিল। গর্ভাবস্থায় শিশুর দেহে এই আয়োডিন লবণের অভাব তথা থাইরয়েড হরমোনের অভাবের ফলে একটি নিষ্পাপ শিশু সারজীবন জড়বুদ্ধি হয়ে যেতে পারে, যাকে বলে ক্রেটিন। তাই এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সাধারণ লবণে আয়োডিন মেশাবার পদ্ধতি সুপ্রচলিত ও বিজ্ঞানসম্মত।
আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক মানব শরীরে টি-থ্রি এবং টি-ফোরের ভূমিকাগুলো কী কী।
প্রধানত দেহের সকল কোষের বিপাকক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ কাজে এই হরমোনগুলো সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। গর্ভস্থ শিশুর নিজস্ব থাইরয়েড মোটামুটি ভাবে ১০-১২ সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করে। গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ বিশেষ ভাবে এই হরমোনগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া শৈশবে মস্তিষ্কের বিকাশও এই হরমোনগুলো ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সে শরীরের দৈর্ঘ বৃদ্ধি বিশেষত অস্থি এবং তরুণাস্থির বৃদ্ধি তথা গ্রোথ হরমোনের কার্যকারিতা বাড়ানো এই হরমোনগুলোর আর একটি প্রধান কাজ, যার অভাবে বামনত্ব প্রাপ্তি বা গ্রোথ ফেলিওর হতে পারে। বয়ঃসন্ধি তথা জননতন্ত্রের বিকাশ ও সুনিয়ন্ত্রণের জন্য এই হরমোনগুলোর প্রভাব থাকে অত্যন্ত সক্রিয়। এই বয়সে এই হরমোনগুলোর অভাব ঘটলে বয়ঃসন্ধি দীর্ঘায়িত বা বিলম্বিত এমনকী অনুপস্থিতও থাকতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এই হরমোনগুলো মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য়।
আসুন এবার সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক কী কী পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় হয়।
হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরোটক্সিকোসিস দু’টো ক্ষেত্রেই প্রাথমিক ভঅবে টি-থ্রি, টি-ফোর অথবা টি.এস.এইচ টেস্ট করা হয়ে থাকে যদিও সব সময় হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে টি-থ্রি জরুরি নয়। সাধারণভাবে হাইপোথাইরয়েডিজমে টি-থ্রি, টি-ফোর কমে যায় এবং ফলে টি.এস.এইচ বেড়ে যায়। টি.এস.এইচ-এর মাত্রা ১০-এর বেশি হলে প্রায় সব ক্ষেত্রেই থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া জরুরি। এটি রোগ সম্পূর্ণ ভালো করে দেবার ওষুধ নয় বরং আপনার শরীরে যে থাইরক্সিন থাকা উচিত ছিল অথচ নেই সেটি বাইরে থেকে জোগান দেবার ব্যবস্থা।
ডাক্তার এর নির্দেশ মতোওষুধ শুরু হবার পর কত ডোজে এটি চলবে তা পরপর দেড় থেকে দু’মাসের মধ্যে কয়েকবার টেস্ট করে জেনে নিতে হয়। এই সময় রক্ত পরীক্ষার ফল স্বাভাবিক সীমার এলেও সেটা কেবল মাত্র ডোজের সঠিকতা নির্ণয় করে, এটি রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাওয়া বা ওষুধ বন্ধ হবার কথা বলে না। একবার সঠিকভাবে ডোজ নির্ণয় হবার পর বারবার টেস্ট করার দরকার হয় না। বিশেষ কোনো শারীরিক অসুবিধা না হলে বছরে একবার পরীক্ষাই যথেষ্ট। আবার টি-থ্রি, টি-ফোর-এর মাত্রা স্বাভাবিক থেকে টি.এস.এইচ-এর মাত্রা স্বাভাবিকের বেশি অথচ ১০-এর কম হলে, ওষুধ খাওয়া জরুরি কি না তা অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে যেমন গলগন্ড আছে কি না, মহিলাটি গর্ভবতী কি না, তার শরীরে অ্যান্টি টিপিও নামক পরীক্ষার ফল পজিটিভ কি না, হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষনগুলো খুব প্রকট কি না ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ার চিকিৎসা সারা জীবন চালিয়ে যেতে হয়।
অন্য যে ব্যাপারগুলো জেনে রাখা ভালো সেগুলো হল থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ সকালে খালি পেটে খাওয়া উচিত। ওষুধ খাবার আধঘন্টার মধ্যে চা বা অন্য কিছু খাওয়া উচিত নয়। ঋতুভেদে ওষুধের মাত্রার কোনো তারতম্য হয় না। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে হাইপোথাইরয়েডের রোগীর ওষুধের মাত্রা বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, যেমন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রোগী বা খিচুনির জন্য যারা ওষুধ খাচ্ছেন অথবা মানসিক রোগে আক্রান্ত কিছু মানুষ। আবার বার্ধক্যে কিছু ক্ষেত্রে এই ওষুধের মাত্রা কমানোর প্রয়োজনও হতে পারে। যারা হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খান তাদের ক্ষেত্রে আয়রন বা ক্যালসিয়াম জাতীয় ওষুধ খাবার প্রয়োজন হলে তা থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাবার অন্তত চার ঘন্টার মধ্যে খাওয়া উচিত নয়।
থাইরয়েডের অসুখ থাকলে খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপারে কিছু প্রচলিত কথা প্রায়ই রোগীদের বিভ্রান্ত করে। যেমন বাধাকপি, পুইশাক, শালগম ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালেঅ যে খাদ্যে বা জলে আযোডিন লবণের পরিমাণ স্বাভাবিক থাকে, সেই জাতীয় খাদ্য খাবার ফলে গলগন্ড হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। কাজেই আয়োডিন ডেফিসিয়েন্ট এলাকা না হলে বা আয়োডিন যুক্ত লবণ খেলে বা যারা হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খান তাদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় সবজিগুলো খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া বিজ্ঞানসম্মত নয়।
অন্যদিকে থাইরোটক্সিকোসিস হলে টি-থ্রি, টি-ফোর বেড়ে যায় এবং এর ফলে টি.এস.এইচ কমে যায়। রোগের সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য প্রায়ই রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন আপটেক ও স্ক্যান বা টেকনিসিয়াম স্ক্যান করা হয়ে থাকে। এটি জানিয়ে দেয় রোগটি গ্রেভস বর্ণিত থাইরোটক্সিকোসিস রোগ না থাইরয়েড গ্রন্থির প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন জনিত রোগ।
হাইপোথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কোনো মহিলা গর্ভধারণ করলে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে গর্ভ ধারণ করবার আগে যে পরিমাণ ডোজে থাইরক্সিন ওষুধ চলছিল তার থেকে ২৫-৫০% পর্যন্ত ওষুধের পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে। এর কারণ হল, মায়ের নিজের শরীরের থাইরয়েড গ্রন্থি যেখানে নিজের জন্য যথেষ্ট থাইরক্সিন প্রস্তুত করতে সমর্থ হয় না এবং মায়ের শরীরে এই সময় নানারকম পরিবর্তন হওয়ায় থাইরক্সিনের প্রয়োজন বাড়ে, পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশু যেহেতু অত্যন্ত তীব্র গতিতে ক্রমবর্ধমান থাকে তার থাইরক্সিন প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি এবং তার নিজের থাইরয়েড গ্রন্থি কাজ করতে বেশ কিছুদিন দেরি হয়, তাই এই সময় ওষুথের ডোজ না বাড়ালে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রসবের পর এই মহিলার সন্তানকে স্তনপান করাতে কোনো আপত্তি নেই।
অন্যদিকে হাইপারথাইরয়েডিজমে আক্রান্ত কোনো মহিলা গর্ভ ধারণ করলে রোগের তীব্রতা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং ওষুধের পরিমাণ কমানোর প্রয়োজন হতে পারে। প্রসবের পর আবার এই রোগের তীব্রতা বাড়তে পারে, তাই এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। উভয়ক্ষেত্রেই দেড়-দু’মাস পরপর পরীক্ষা করে সঠিকভাবে ডোজ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
আবার থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যানসার হলে যে যে লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হল গ্রন্থির ভেতর কোনো মাংসপিন্ডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খুব শক্ত ধরনের হয়। এছাড়া গলার দু’ধারে অবস্থিত কোনো লসিকা গ্রন্থির হঠাৎ উদ্ভব হতে পারে বা পূর্ববর্ণিত কোনো পারিপার্শ্বিক অঙ্গের কর্মপ্রক্রিয়ায় বাধা পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে অতিসত্বর কোনো চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ বিশেষ প্রয়োজন। কারণ থাইরয়েড। কারণ থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যানসার হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক সময়ে চিকিৎসা হলে সেরে যায় বা জীবনকাল প্রলম্বিত করা যায়। এই সব ক্ষেত্রে বিলম্ব না করে যে যে পরীক্ষা করা উচিত তা হল থাইরয়েড গ্রন্থির আলট্রাসোনোগ্রাফি এবং এফ.এন.এ বা ফাইন নিডিল অ্যাসপিরেশন। ক্যানসার হলে তাড়াতাড়ি অপারেশনের মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থি প্রায় সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বেশি ডোজে রেডিও অ্যাক্টিভ আয়োডিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ সেরে গেলেও সামান্য কয়েক ধরনের ক্যানসারের ক্ষেত্রে এর চিকিৎসা বেশ জটিল এবং বেশি দেরি হলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা অনেক কম। থাইরয়েড গ্রন্থি প্রায় সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দেবার পর আজীবন থাইররিক্সন জাতীয় ওষুধ খাবার প্রয়োজন হয়।
এছাড়াও একটি বিশেষ রোগ হতে পারে, গ্রন্থির ভেতর কোনো অংশে জলীয় পদার্থ জমে যেতে পারে, যার নাম থাইরয়েড সিস্ট। এটিও চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
পরিশেষে জানাই, থাইরয়েডের রোগ নিয়ে জনমানসে রয়েছে নানারকম ভূল ধারণা। এই গ্রন্থির অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা করায়ত্ত। কাজেই অহেতুক ভয় না পেয়ে এবং গুজব না ছড়িয়ে যত শীঘ্র সম্ভব চিকিৎসা করলে এই রোগের নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সম্ভব।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ ,কলিকাতা
Discussion about this post