ডা. মোঃ ফারুক হোসেন
সুন্দর হাসির পূর্ব শর্ত হলো সুন্দর দাঁত। তাই আমরা সবাই চাই ঝকঝকে মুক্তার মতো দাঁত। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় আঁকাবাঁকা, ফাঁকা ও উঁচু নিচু দাঁতের কারণে অনেকে নিজেকে কিছুটা লুকিয়ে রাখেন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও প্রাণ খুলে হাসতে পারেন না। অথচ অসচেতনতার কারণে দাঁতের এমন সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন নির্দিষ্ট বয়সের আগে দুধদাঁত ফেলে দেয়া অথবা দীর্ঘদিন পর্যন্ত রেখে দেয়া, অতিরিক্ত কোনো দাঁত থেকে যাওয়া বা কোনো দাত কম থাকা, শিশুদের আঙুল চোষার অভ্যাস থাকা এবং নাকের পরিবর্তে মুখ দিয়ে শ্বাস নেয়া। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য এ সমস্যায় ব্যক্তির নিজস্ব হাত থাকে না। যেমন দাঁতের আকার চোয়ালের তুলনায় বড় বা ছোট হওয়া, দাঁত ও তার চারপাশের মধ্যে ভারসাম্য না থাকা, মুখের মধ্যে কোনো টিউমার বা সিস্ট থাকা ইত্যাদি। কখনো কখনো বংশগত কারণেও দাত এলোমেলো হয়ে থাকে।
আঁকাবাঁকা দাঁতে ক্ষেত্রে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হয়, অন্যথায় মাড়ি প্রদাহ, ডেন্টাল কেরিজ, দাঁতে অতিরিক্ত প্লাক জমাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
১. নিয়মিত দাত মাজার পর একটি সাদা কাপড় দিয়ে আপনার আঁকাবাঁকা দাঁতগুলো ঘষে নিন। এতে দাঁতের বাড়তি ময়লা দূর হবে এবং বাঁকা দাত খুব একটা দৃষ্টিকটু দেখাবে না।
২. শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাবার দাঁতের ফাঁকে জমে দাঁত দ্রুত ক্ষয় করে এবং এর মসৃণতা নষ্ট করে। তাই এসব খাবার গ্রহণের পর সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশ করুন। ভালোভাবে কুলি করে দাত পরিষ্কার করে নিন।
৩. ওপর-নিচে, ভেতর ও বাইরে সব দিকে পরিষ্কার করুন। বাঁকা দাঁতে ময়লা বেশি জমে। তাই একটু সময় নিয়ে ব্রাশ করুন।
৪. অনেক সময় একই স্থানে দুটি দাঁত গজায়, সেক্ষেত্রে ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী একটি দাঁত তুলে ফেলুন। অনেকের দুটি দাঁতের মাঝে ফাঁকা স্থান বা ভাঙা দাঁত থাকে। এক্ষেত্রেও যত দ্রুত সম্ভব চিকিত্সকের দ্বারস্থ হওয়া ভালো।
৫. শিশুদের ক্ষেত্রে দাত ওঠার শুরু থেকেই সতর্ক হোন, বোতলে দুধ খাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন এবং ভালোভাবে দাঁত ব্রাশ করা শেখান।
৬. দুধদাঁতে প্রক্সিমাল ক্যারিজ হলে দ্রুত চিকিত্সা করান।
এই তো গেলো আঁকাবাঁকা দাতের যত্নের বিষয়, তবে বর্তমানে বিভিন্ন ডেন্টাল ক্লিনিকগুলোতে দাত সোজা করার জন্য বিভিন্ন আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রেস পরানো, ডেন্টাল রিফর্মেশন ইত্যাদি নানা পদ্ধতি এখানে সুলভে পাওয়া যায়।
আঁকাবাঁকা দাঁত সোজা করা কতটুকু সম্ভব?
যে কোন ধরণের আঁকাবাঁকা দাঁতেরই চিকিৎসা সম্ভব। সাধারণত চার বছর থেকেই আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা শুরু হয়। তবে ১২ বছর বয়স থেকে দুধদাঁত পড়ে নতুন দাঁত উঠলে তখন এর চিকিৎসা করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। যাঁদের বয়স হয়েছে, তাঁরাও চিকিৎসা করাতে পারবেন। কেননা দুধদাঁত পড়ে আবার ওঠার পর এর গ্রোথ প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে এক্স-রের মাধ্যমে আঁকাবাঁকা দাঁত শনাক্ত করা হয়। যেসব দাঁত অতিরিক্ত সেগুলো তুলে ফেলতে হয়। এ ছাড়া কিছু স্থায়ী দাঁত, যা অন্য একটি বা দুটি দাঁতের ওপরে বা নিচে অবস্থান করে, সেগুলোও প্রয়োজনবোধে তুলে ফেলতে হয়। নচেৎ খাদ্যদ্রব্য চিবানোয় ঝামেলা তৈরি হয় এবং দাঁত অসমান থাকায় খাদ্যকণাও জমা হয়।
উঁচুনিচু বা আঁকাবাঁকা দাঁত থাকলে চিকিৎসার সময় দাঁতের ব্রেস লাগিয়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ব্রেসের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয় বলে একে ব্রেস সিস্টেম বলা হয়।
ব্রেস সিস্টেম বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। সেগুলো হলো :
(ক) বেগস্ টেকনিক বা কৌশল : অস্ট্রেলিয়ায় এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
(খ) আলেকজান্ডার টেকনিক বা কৌশল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
(গ) রথ টেকনিক বা কৌশল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
(ঘ) স্টেইট ওয়ার টেকনিক বা কৌশল : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করা হয়।
বাংলাদেশের চিকিৎসা পদ্ধতি : আমাদের দেশে ফিক্সড অর্থোডন্টিক চিকিৎসায় স্ট্যান্ডার্ড এজ ওয়াইজ সিস্টেম আঁকাবাঁকা বা উঁচুনিচু দাঁতের চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে আমাদের দেশে এই চিকিৎসা চলে আসছে। বাংলাদেশ ছাড়া জাপান ও আমেরিকায় এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়।
চিকিৎসা শুরুর সময় : মনে রাখতে হবে মুখের আঁকাবাঁকা দাঁতের চিকিৎসা শুরু করার একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। তবে এটি শুধু ফিক্সড্ অর্থোডন্ডিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ক্যানাইন বা বিউটি দাঁতের রুট বা গোড়া পুরোপুরি গঠনের পরেই কেবল ফিক্সড অর্থোডন্টিক চিকিৎসা শুরু করা যাবে। তার মানে দাঁড়াল বিউটি দাঁতের অর্থাৎ তিন নাম্বার দাঁতের গঠন শেষ না হওয়া পর্যন্ত মুখের সার্বিক বিউটি নিমিত্তে ব্রেস সিস্টেম প্রয়োগ করা যাবে না। পাশাপাশি রোগীর মুখে উপরে এবং নিচের চোয়ালে প্রথম স্থায়ী মোলার দাঁত অর্থাৎ ৬ নম্বর দাঁত থাকতে হবে। প্রথম স্থায়ী মোলার দাঁত না থাকলে চিকিৎসার করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।
চিকিসার করার বয়সসীমা : আমাদের দেশে অনেকের মাঝে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে বয়স বেশি হয়ে গেলে আর বুঝি আঁকাবাঁকা বা উঁচুনিচু দাঁতের চিকিৎসা করা যাবে না। কথাটি মোটেও সত্য নয়। মূল ব্যাপারটি হলো একটি দাঁতের পেরিওডন্টাল রিগামেন্ট অবশ্যই ভাল হতে হবে। পাশাপাশি দাঁতের পাশে সংযুক্ত হাড়ের অবস্থা সুস্থ হতে হবে। তাহলে বয়স বেশি হয়ে গেলেও দাঁতের চিকিৎসা করাটা কঠিন কোন ব্যাপার নয়। আবার কারও বয়স বেশি নয় কিন্তু সিস্টেমিক রোগে আক্রান্ত বিশেষ করে যদি কেউ ডায়বেটিস রোগে আক্রান্ত হন তাহলে ব্রেস সিস্টেম অর্থাৎ ফিক্সড অর্থোডন্টিক চিকিৎসা করাটা আসলেই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
চিকিৎসার সময় করণীয় : ব্রেস সিস্টেম চিকিৎসার সময় যে সব ব্যাপারে রোগীর সচেতন হতে হবে সেগুলো হলো :
(ক) মুখ গহব্বর পরিষ্কার রাখা।
(খ) বিশেষ পদ্ধতিতে দাঁত ব্রাস করা।
(গ) অসুস্থতার কারণে একান্তই দাঁত ব্রাস করতে না পারলে মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করতে হবে।
ট্রেনার : মুখে যখন দুধ দাঁত এবং স্থায়ী দাঁত দুটোই থাকে তখন চোয়ালে অসামঞ্জস্য দূর করার জন্য ট্রেনার ব্যবহার করা হয়।
অর্থোগন্যাথিক সার্জারি : অনেকের উপরের চোয়াল বা ম্যাক্সিলারি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় থাকে যাকে ম্যাক্সিলারি প্রগনাথিজম বলা হয়। আবার অনেকের নিচের চোয়াল বা ম্যান্ডিবল বড় থাকে যাকে ম্যান্ডিবুলার প্রগনাথিজম বলা হয়। উপরের চোয়াল এবং নিচের চোয়াল বড় থাকলে ব্রেস সিস্টেমে চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে অপারেশন করে চোয়াল স্বাভাবিক করে নেয়া হয়। এ সার্জারিকে অর্থোগন্যাথিক সার্জারি বলা হয়।
পরিশেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন ব্রেস সিস্টেম মুখের সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারে এবং রক্ষায় আশীর্বাদস্বরূপ। তাই সর্বসাধারণকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
ওরাল এ্যান্ড ডেন্টাল সার্জন
Discussion about this post