সূর্যের তীব্র উষ্ণতা এবং বাতাসের আর্দ্রতা মিলিয়েই গ্রীষ্মকাল। আর গ্রীষ্মকালই হল ছত্রাকের অনুকূল পরিবেশ। সাধারণ দেহের চাপা অংশগুলোতে ঘাম জমে এবং খুব সহজে রোগ সংক্রমণ হয়। যেমন দাদ, ছুলি, চুলকানি, নখকুনি, ফোঁড়া, ঘামাচি, একজিমা, অ্যার্টিকেরিয়া ইত্যাদি।
দাদ
গ্রীষ্মকালের অতি পরিচিত সমস্যা হল দাদ। দাদ একটি ছত্রাক ঘটিত চর্মরোগ। গরমের সময় শরীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে ঘাম জমে থাকে। ঘর্মাক্ত আর্দ্রস্থানে দাদের ছত্রাক আক্রমণ করে। বগলে, কুচকিতে, মহিলাদের কোমরে, বুকের খাজে, ঘাড়ে ছাড়াও শরীরের অন্যান্য অঙ্গে দাদ হতে দেখা যায়। গোল গোল চাকা দাগ হয়। অনেকটা রিং-য়ের মতো। আক্রান্ত স্থানে খুব চুলকায়, রস বের হয়, বেশ জ্বালাও করে। সাধারণত শরীরের যে অংশে দাদ হয় সেই অংশ অনুযায়ী রোগের নামকরণ হয়। যেমন গায়ে হলে টিনিয়াকরপোরিস, গোঁফ বা দাড়িতে হলে টিনিয়াবারবি, কুচকিতে হলে টিনিয়া এরিস ইত্যাদি।
দাদ প্রতিরোধের প্রথম কথা হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরতে হবে। শরীরে যে সব জায়গা ঘাম হয় সেই সব জায়গা শুকনো তোয়ালে দিয়ে মোছা উচিত।
দাদের লক্ষণ অনুযায়ী ক্রাইসোরবিনিক অ্যাসিড, ব্যাসিলিনাম ওষুধ ভালো কজ দেয়।
হাজা
এটি একটি ছত্রাক জনিত ত্বকের সমস্যা। এই সমস্যা সারা বছরই হয়। তবে গ্রীষ্ম-বর্ষায় এই রোগের প্রকোপটা বাড়তে শুরু করে। যারা বেশি জল ঘাটেন, বাথরুমে বেশিক্ষণ সময় কাটান অথবা যাদের হাত-পা বেশি ঘামে তাদের মধ্যেই হাজা হতে বেশি দেখা যায়। এই ছত্রাকটির নাম হল ক্যানডিডা-অ্যালবিক্যানস। হাত ও পায়ের খাজে সাদাটে দাগ হয় এবং প্রচন্ড চুলকোয়। আবর কখনও হাজার ওপর ব্যক্টেরিয়ার সংক্রমণ হয়। এর ফলে ব্যথাও হয়। পা পেতে হাঁটতে কষ্ট হয়।
যাদের বারবার হাজা হওয়ার সমস্যা হচ্ছে তারা একটু ব্লাডসুগার টেস্ট করিয়ে নিন। আক্রান্ত জায়গা যখনই ভিজে যাবে সঙ্গে সঙ্গে শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে নিন। খাওয়ার ওষুধ হিসেবে ফ্লুকোমোজোল, কিটোকোনাজোল, ইট্রাকোমাজোল গ্রুপের ওষুধ নির্দিষ্ট পরিমাণে খাওয়ানো যেতে পারে। লাগানোর ওষুধ হিসেবে ক্লোট্রিমাজাল জাতীয় ক্রিম লাগানো যেতে পারে।
নখকুনি
বর্ষাকালেই নয়, প্রায় সারা বছরই নখকুনি হওয়ার সমস্যা তৈরি হয়। নখকুনি যে শুধু নখের কোণায় হয় তা নয়, কোণা থেকে শুরু করে পুরো নখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নখের কোণায় জল জমে থাকলে বা ঘামে ভেজা পা থেকে নখকুনি হবার সম্ভাবনা থাকে। নখের কোণাগুলো ফুলে লাল হয়ে ওঠে। অনেক সময় পুজ জমে এবং খুব দুর্গন্ধও হয়। এটি এক ধরনের ছত্রাক থেকে হয়। ক্রনিক ছত্রাক হলে সারতে দেরি হয়।
প্রতিকার হিসেবে বলা যায়, যতটা সম্ভব জলঘাটা বন্ধ করতে হবে। নখে জল জমতে দেওয়া চলবে না। নখকুনি সাধারণত পায়েই দেখা যায়। যদি এর ওপর ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমণ হয় তখন নখের গায়ে লেগে থাকা ত্বকে চাপ দিলে পুঁজ বের হয়। একে অ্যাকিউট প্যারনেশিয়া বলা হয়। এই ক্ষেত্রে সাত থেকে দশ দিনে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে আশুমেনটিন ৬২৫ এম.জি অথবা অ্যাজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের ওষুধ নিতে হবে আর লাগানোর ওষুধ হিসেবে মিউপোরেসিন গ্রুপের ওষুধ সাত থেকে দশদিন লাগাতে হবে। এছাড়া নখকুনির জন্য খাবার ওষুধ হিসেবে ট্যাবলেট কোনাজল, কিটোকোনাজল আর ক্যাপসুল হিসেবে ইরেকোনাজোল খেতে হবে। আর লাগানোর জন্য কিটোকোনাজল ক্রিম, জিষ্ক পাইরিথিওন ক্রিম লাগাতে হবে।
ফোড়া-ফুসকুড়ি
গ্রীষ্মকালে দরদরে ঘাম থেকে ব্যাক্টেরিয়াঘটিত ফোঁড়া, ফুসকুড়ির জন্ম হয়। প্রথমে শরীরের কোনো একটা অংশ লাল হয়ে ফুলে ওঠে। সেই সঙ্গে ব্যথা ও যন্ত্রণা হয়। তারপর ফোলা জায়গার মুখে রক্ত ও পুজ জমে। কখনও কখনও একসঙ্গে অনেকগুলো ফোঁড়াও হতে দেখা যায়। ফোঁড়া বেশিহলে যন্ত্রণা তীব্র হয়। রোগী ভীষণ কষ্ট পায়। এক্ষেত্রে ফোঁড়ার লক্ষণ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়া দরকার। গরমে ঘামে ভিজে থাকা ত্বকে এইসব জীবাণু খুব সহজেই বাসা বাঁধতে পারে।
প্রতিকার হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করতে হবে। অল্প হলে ফোঁড়ার জায়গায় মিউপোরোসিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ক্রিম লাগাতে হবে। খাওয়ার ওষুধ হিসেবে আগুমেনটিন-৬২৫ দিনে দু’বার করে অথবা অ্যাজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের ওষুধ ৫০০ এম.জি করে দিনে দু’-তিনবার করে খেতে হবে। যদি খুব বেশি হয় তখনই খাবার ওষুধ খেতে হবে। বয়স্ক কোনো ব্যক্তির যদি বারবার ফোঁড়া হতে থাকে তাহলে একবার ব্লাডসুগার পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। কারণ রক্তে শর্করার হার বেড়ে গেলে ফোঁড়া হবার প্রবণতা বাড়ে। অনেকের ধারণা বেশি পরিমাণ আম খাওয়ার ফলে হয়তো ফোঁড়া, ফুসকুড়ি বেশি হয়। কিন্তু এই ধারণা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিষয়টা নেহাতই কাকতালীয়।
ছুলি
ছুলি সারা বছরই হয় কিন্তু গরমে ঘামের কারণে আর বর্ষাকালের স্যাতসেতে আবহাওয়ায় বেশি বাড়ে। এই ছত্রাক বেশির ভাগ সময় আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়ায় বেশি পরিমাণে ত্বকে বাসা বাধে। এটা অল্পবয়সীদের বেশি হয়। খুব বয়স্কদের এই সমস্যা হয় না বললেই চলে। এটা আবার কয়েকটা ক্ষেত্রে বেশি হতে পারে। গর্ভাবস্থায় কোনো জটিল অসুখ বা বংশগত প্রবণতার কারণে, এছাড়া যারা কোনো কারণে স্টেরয়েড নিচ্ছে অথবা যাদের রক্তে শর্করার হার বেশি তাদে ছুলির সংক্রমণ হতে পারে।
নিয়মিত চিকিৎসায় ছুলি সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায়। ছুলি হলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কোনোভাবে ঘাম জমতে দেওয়া উচিত নয়। বৃষ্টিতে ভিজে গেলে ভালো করে মুছে নেওয়া উচিত। হালকা সুতির জামাকাপড় পরা উচিত । এছাড়া খাওয়ার ওষুধ হিসেবে কিটোকোনাজোল ট্যাবলেট সপ্তাহে একটা করে কিছু খাওয়ার পরে চার থেকে ছ’সপ্তাহ অথবা ইটরাকোনাজল জাতীয় ক্যাপসুল সপ্তাহে একটা করে চার থেকে ছ’সপ্তাহ খেতে পারেন। এছাড়া আগেকার ওষুধ হিসেবে ক্লোটাই মাজল জাতীয় অথবা কিটোকোনোজল অথবা জিষ্ক পাইরিথিউনি জাতীয় ক্রিম দিনে দু’বার করে চোদ্দদিন লাগানো যেতে পারে। অনেক সময় মাথায় ছুলির ছত্রাকও বাসা বেধে থাকে। তাই লাগানো বা খাওয়ার ওষুধের সাথে সাথে কিটোকোনাজল জাতীয় শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঘামাচি
গরমকালে সবচেয়ে বিরক্তিকর সমস্যা হল ঘামাচি । অতিরিক্ত গরম পড়লে শরীরের চামড়ার ওপর লালচে বা গোলাটি বর্ণের ছোট ছোট জল ভর্তি এক ধরনেরগোটা ফুটে ওঠে এবং মাঝে মাঝেই তা চলকাতে থাকে। ঘামাচির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। পোশাক সুতির হলে ভালো। ঢিলেঢালা পোশাক পরলে শরীরে আরামদায়ক হয়। ঘাম কম হলে ঘামাচিও কম হবে। ঘামাচি রোধ করতে প্রিকলিহিট পাউডার ব্যবহার না করাই ভালো। এতে ঘর্মগ্রন্থির মুখে আটকে গিয়ে আরো ঘামাচির সৃষ্টি হয়। এর বদলে ডিওডোরান্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, এতে ঘামের দুর্গন্ধ যেমন কমে. ঘামের প্রকোপটাও তলনামূলক কম হয়।
যাদের ঘামের পরিমাণ খুব বেশি তাদের জল বেশি করে খাওয়া উচিত। অ্যালমিনিয়াম ক্লোরাইড অথবা অ্যালুমিনিয়াম হাইঙ্গক্সাইডের সলিউশন খুব কার্যকার হয়। এর মধ্যে অ্যালকোহলের মিশ্রণ থাকে না। ঘাম কম হতে সাহায্য করে।
একজিমা
হাত, পায়ে বা শরীরের অন্যত্র ছোটখাটো জলভরা ফুসকুড়ি হয়, চুলকোয়। অবহেলায় সংক্রমণ হতে পারে। একজিমার কারণ খুব ভালোভাবে এখনও জানা যায়নি। তবে বংশগত প্রভাব আছ। একজিমা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। একবার সেরে গেলে আবারও হতে পারে। তাই এ সব নিয়ে টেনশন করা উচিত নয়। ইরিট্যান্ট সাবান, ডিটারজেন্ট, কাঁচা তরিতরকারির রস যাতে না লাগে তা দেখা দরকার। টেনশনে একজিমা বাড়ে। বম ক্ষারযুক্ত সাবান, গ্লিসারিন যুক্ত সাবান, বেবি সোপ ব্যবহারের পক্ষে ভালো।
এই রোগে প্রধানত অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় বড়ি, ফেক্সোফিনাডাইন বা লোরাপিডাইন জাতীয় ওষুধ ১৮০ এম.জি দিনেরবেলা খেতে হবে। আর রাতে সেট্রিজিন অথবা হাইঙ্গোএক্সাইজিমা জাতীয় বড়ি ১০ এম.জি খাওয়া যেতে পারে। এই ওষুধ তিন থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত খাওয়া ফুল্টিকাসোন অথবা মোমেটাসোন জাতীয় ক্রিম দু’তিন সপ্তাহ লাগানো যেতে পারে।
যদি কখনো খুব বাড়াবাড়ি হওয়ার মতো হাতের পাতা বা পায়ের পাতা বা গোড়ালি শক্ত হয়ে ফেটে যায়, রত্দ বেরোতে থাকে তখন বিটামাথসোন অথবা ক্লোবেটাসল জাতীয় মলম লাগানো যেতে পারে।
যতটা সম্ভব সুতির জামাকাপড় পরা উচিদ। যে সব গুহবধু একজিমার সমস্যায় ভোগেন তারা কাজ করার আগে হাতে নারকেল তেল মাখতে পারেন অথবা বাজারে প্রচলিত এক ধরনের গ্লাভস পাওয়া যায় সেগুলো ব্যবহার করে কাজ করে যেতে পারে।
আমবাত
ডাক্তারি পরিভাষায় বলে আর্টিকেরিয়া। এটা এক ধরনের অ্যালার্জি। আক্রান্ত স্থানে লাল চাকা চাকা দাগ দেখা যায়। প্রচন্ড চুলকোয়, জায়গাটা গরম হয়ে ওঠে। চিংড়িম কচ্ছপের মাংস, ডিমের মতো বিশেষ কিছু খাদ্য থেকে, কিছু ওষুধ, ফুলের পরাগরেণু থেকে পোকার কামড় থেকে, কৃমি সংক্রমণ থেকে, থাইরয়েড ও ডায়াবেটিসের মতো জটিল কিছু অসুখের জন্য আমবাত হতে পারে। বারে বারে হলে রক্তে ইওসিনোফিল কণার মাত্রা দেখে নিতে হবে।
অ্যালার্জি পরীক্ষা করে কী কারণে অ্যালার্জি সেটা জানতে হবে। প্রয়োজনে রক্তের থাইরয়েড হরমোন টি-থ্রি, টি-ফোর, টি.এস.এইচ এবং সুগারের মাত্রা দেখে নিতে হবে।
সৌজন্যে: ‘সুস্বাস্থ্য’ – কলকাতা
Discussion about this post