ডা: অমিত ঘোষ, কলিকাতা
রাত্তিরে বারেবারে বাথরুম দৌড়তে হলে ঘুমের যে বারোটা বাজবে তা স্বাভাবিক। পঞ্চান্ন – ষাট বছর পেরিয়ে যাওয়া প্রৌঢ়দের এ এক কমন উপসর্গ। আর রাত্তিরে বারে বারে উঠলে ঘুমের যে বারোটা বাজবে সে তো স্বাভাবিক। আসলে বয়স বাড়ার সঙ্গে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড বেড়ে ওঠে। আখরোটের আকৃতির এই গ্ল্যান্ডটি মূত্রথলির ঠিক নিচে মূত্রনালীর চারপাশে থাকে বলে প্রস্রাবের সমস্যা শুরু হয়। বয়স বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মে প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের কার্যক্ষমতা কমতে শুরু করে। আর গ্রন্থিটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই গ্রন্থিতে ক্যানসার হলেও প্রস্টেট বেড়ে ওঠে। তাই ৪৫ বছর বয়সের পর প্রস্রাবের সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখানো জরুরি।
প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের ক্যানসার ক্রমশ বাড়ছে
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের (ICMR) সমীক্ষায় জানা গেছে প্রস্টেট ক্যানসার আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা অন্যান্য ক্যানসারের নিরিখে দ্বিতীয় স্থানে। দুবছরের মধ্যেই প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে প্রস্টেট ক্যানসারের একটা সুবিধেজনক দিক হল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি অত্যন্ত ধীর গতির ( স্লো গ্রোয়িং ক্যানসার)। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করলে পুরোপুরি ক্যানসার মুক্তি সম্ভব। তাই যে কোনও সমস্যা হলে রোগ গোপন না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর ৪৫ পেরোনর পর বছরে অন্তত একবার ইউরোলজিস্টের পরামর্শে পিএসএ অর্থাৎ প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট করিয়ে নিন। তবে প্রস্টেটের সমস্যা মানেই যে ক্যানসার একথা মনে করার কোনও কারণ নেই।
- রাত্তিরে একাধিক বার বাথরুম দৌড়তে হয়
- ·বারবার বাথরুম যেতে হয়। প্রচন্ড বেগ আসে কিন্তু টয়লেটে গিয়ে প্রস্রাব শুরু হতে বেশ অসুবিধে হয়।
- ·দিনের বেলাতে তো বটেই, রাত্তিরেও একাধিকবার বাথরুমে দৌড়তে হয়। রাতের অনেকটা সময় বাথরুমে কাটাতে হয় বলে ভালো করে ঘুম হয় না।
- ·বেগ থাকলেও ইউরিনের ফ্লো আগের থেকে অনেকটাই কমে যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে হেসিটেন্সি।
- ·প্রস্রাব পেলেও শেষ হতে অনেক সময় লাগে। আগে যেখানে এক থেকে দেড় মিনিট সময় লাগত, সেখানে দুই থেকে তিনগুন সময় বেশি লাগে। কিছুতেই যেন প্রস্রাব শেষ হতে চায় না।
- ·প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বেরোনর সম্ভাবনা বাড়ে।
- ·কোমর, ঊরু সহ লো ব্যাক পেন হতে পারে।
- ·ইরেকটাইল ডিসফাংশন হতে পারে,
- ·কোমর ও এর আশেপাশে অস্বস্তি ও ব্যথা হয়।
- ·প্রস্রাব ধরে রাখতে অসুবিধে হয়।
- ·প্রস্টেট গ্ল্যান্ড অতিরিক্ত বড় হয়ে গেলে অনেক সময় প্রস্রাব আটকে যেতে পারে। একে বলে রিটেনশন অফ ইউরিন। এক্ষেত্রে অবিলম্বে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে ক্যাথিটারের সাহায্যে সাময়িক রিলিফ দেওয়া হয়।
পিএসএ পরীক্ষা করাতেই হবে
পিএসএ টেস্ট করেই প্রস্টেট ক্যানসার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা করা যায়। তবে কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা করিয়ে তবেই রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে তার আগে ডিজিটাল রেক্টাল এক্সামিনেশন করা দরকার। এই পরীক্ষায় যদি দেখা যায় যে প্রস্টেট গ্ল্যান্ডটি শক্ত নডিউলের মত হয়েছে, তখন প্রস্টেট ক্যানসারের সম্ভাবনার কথা ভাবতে হয়। পিএসএ-র পরিমাণ চার এর থেকে অনেক বেশি হলে ক্যানসারের আশংকা করা হয়। প্রয়োজনে সিটি স্ক্যান, এমআরআই ও বায়োপ্সি করে ক্যানসারের স্টেজ নির্ণয় করা হয়। ক্যানসার কতটা ছড়িয়ে পড়েছে জানতে আইসোটোপ বোন স্ক্যান করার প্রয়োজন হতে পারে।
ক্যানসার নির্মুল করা যায়
টেস্ট করে যদি দেখা যায় যে ক্যানসার প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে, তাহলে র্যাডিক্যাল প্রস্টেটেক্টমি করে ক্যানসারকে সমূলে বাদ দেওয়া হয়। অনেক সময় সার্জারির পরিবর্তে র্যাডিক্যাল রেডিওথেরাপির সাহায্যে প্রস্টেট ক্যানসারের কোষগুলিকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও সার্জারি বা রেডিওথেরাপি কিছুই না করে নিয়মিত পর্যবেক্ষন করা হয়। ক্যানসার অ্যাডভান্সড স্টেজে পৌঁছে গেলে হরমোন থেরাপির সাহায্য নিয়ে ক্যানসারকে পুরোপুরি আটকে দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং ক্যানসার হলে মৃত্যুভয়ে সিটিয়ে না থেকে সঠিক চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে রোগ সারান।
প্রস্রাব সংক্রান্ত কোনও রকম সমস্যা হলে অবশ্যই ইউরোলজিস্টের পরামর্শ নেবেন। প্রস্টেট ক্যানসার মূলত বেশি বয়সের অসুখ। অন্যান্য শারীরিক সমস্যা থাকলেও র্যাডিক্যাল প্রস্টেক্টোমি, হরমোন থেরাপি বা ব্র্যাকি থেরাপি করে এই রোগ সম্পূর্ন নির্মুল করা যায়। বয়স বেশি বলে ভয় পেয়ে অসুখ পুষে রাখলে সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। বেশি বয়সের অসুখ প্রস্টেট ক্যানসার জয় করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা আজ আর গল্প কথা নয়। ৮০ পেরিয়েও প্রস্টেট ক্যানসার সার্জারি করে সুস্থ আছেন এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম নয়। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করুন। ভাল থাকুন।
Discussion about this post