হার্টবিট ডেস্ক
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে দেশের প্রথম লিভার ক্যান্সার রোগীদের সর্বাধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তি ট্রান্স আরটারিয়াল কেমো-এম্বোলাইজেশনের (টেইস) চিকিৎসা শুরু হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আজ (১৫ ডিসেম্বর) বৃহস্পতিবার হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজল করিমের নেতৃত্বে এক রোগীর অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
ঐতিহাসিক এ চিকিৎসা কার্যক্রমে তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিলেন হেপাটোলজি বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রভাত কুমার পোদ্দার, সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈকত হোসেন ও সহকারী অধ্যাপক ডা. নাসিরুল ইসলাম। এ ছাড়া রেজিস্ট্রার ডা. ফাহিম হাসান ও টিএ ডা. আশরাফসহ কার্ডিওলজি বিভাগের অন্যান্য স্টাফরা সহযোগিতা করেছেন।
বিষয়টি মেডিভয়েসকে নিশ্চিত করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফজল করিম।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী লিভার ক্যান্সার যেসব চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে টেইস অত্যন্ত কার্যকর জানিয়ে ডা. মোহাম্মদ শওকত হোসাইন বলেন, ‘এ চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর লিভারে যে স্থানে টিউমার থাকে, সেখানে রক্তনালীর ভিতর দিয়ে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। এটি অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির। এ ধরনের কাজে অনেক বেশি দক্ষতার প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে সর্বপ্রথম সলিমুল্লাহ মেডিকেলে লিভার ক্যান্সার চিকিৎসার এই চিকিৎসা শুরু হয়েছে। ক্যাথল্যাব ছাড়া এ কাজটি করা সম্ভব নয়। অতীতে এই কাজগুলো বেসরকারি হাসপাতালে হতো। খরচ পড়তো তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। রোগীরা অনেক ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা এখন থেকে স্বল্পমূল্যে পাবে।
এ অস্ত্রোপচারকে দেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য মাইলফলক উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসার এ বিরাট অর্জনকে বিজয়ের মাসে মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ ও দুই লাখ নির্যাতি মা-বোনের জন্য আমরা উৎসর্গ করলাম।’
দেশে লিভার ক্যান্সার তৃতীয় সর্বোচ্চ ক্যান্সারের কারণ জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘দিন দিন লিভার ক্যান্সার ও লিভার সিরোসিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই এটি ক্যান্সারের প্রথম কারণ হিসেবে চলে আসবে। অনেক লিভার রোগীকে এতোদিন ভালো চিকিৎসা দেওয়া যেতো না। এখন যেহেতু সরকারি পর্যায়ে চালু করতে পেরেছি, তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহজে চিকিৎসা দিতে সক্ষম হবো।’
‘দেশে যে দুই-চারটা বেসরকারি হাসপাতালে লিভার ক্যান্সারের এই চিকিৎসা দেওয়া হয়, এতে খরচ অনেক বেশি। এর ব্যয়ভার সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ দেশের বাইরেও যেতেন। অনেকে অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা নিতে পারতেন না। সরকারিভাবে সেবাটি চালু হওয়ার কারণে রোগীরা উপকৃত হবেন। অনেক রোগীকে যখন চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসবো, তখন এ পদ্ধতি লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় বড় ধরনের সহায়ক শক্তি হিসেবে রূপ নেবে’, যোগ করেন ডা. মোহাম্মদ শওকত হোসাইন।
গত ছয় মাসের প্রস্তুতিতে কাজটি সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ রকম একটি কাজ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। আমরা আবেগ-আপ্লুত। কাজটি করা পর কোনো সমস্যা দেখা দিলে, তা যেনো অতিক্রম করা যায়, সেজন্য প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি দুটিই রয়েছে। এই কাজের জন্য আমরা লেখাপড়া করেছি, প্রশিক্ষণ নিয়েছি। যখন বুঝতে পারলাম, আমরা একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছি, তখন অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলাম।’
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ-উন-নবীর উৎসাহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে টেইস পদ্ধতির বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন,‘পরিচালক নতুনকে সর্বদা বরণ করেন। তিনি কাজটি করার জন্য সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। আরও সহযোগিতা করেছে হৃদরোগ বিভাগ। ওই বিভাগের ক্যাথল্যাবে কাজ করেছি।’
এদিকে টেইস পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেওয়া রোগীটির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সলিমুল্লাহ মেডিকেলের লিভার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. ফজল করিম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘রোগী হাসপাতালে আমাদের তত্ত্বাবধানে আছেন। বর্তমান অবস্থা ভালো। দুই থেকে চারদিন ফলোআপে রাখার পর বুঝা যাবে।’
খরচ সম্পর্কে এই চিকিৎসক জানান, ‘এই চিকিৎসা অহরহ এবং সরকার থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হলে চিকিৎসার খরচ আরও কমে আসবে। অর্থাৎ ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মতো টাকা লাগতে পারে।’
লিভারে রোগীর অবস্থা জানিয়ে ডা. ফজল করিম বলেন, ‘দেশে লিভার ক্যান্সারের ‘বি’ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব পাঁচ শতাংশ। ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত অনেক রোগী লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আমাদের সরকারি হাসপাতালে অনেক রোগী আসেন।’
অস্ত্রোপচারের পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, মাসে ১২ থেকে ১৬টি অস্ত্রোপচার করার পরিকল্পনা রয়েছে। অন্যান্য সরকারি হাসপাতাল এই ধরনের অপারেশনের সহযোগিতা চাইলে এ ব্যাপারে সহযোগিতারও কথা জানান তিনি।
এ বিষয়ে নিজের অনুভূতির কথা জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. কাজী মো. রশীদ-উন-নবী বলেন, ‘সরকারি পর্যায়ে এই প্রথম মিটফোর্ড হাসপাতালে এ রকম একটি কাজ সম্পন্ন হলো। আমার অনেক ভালো লাগছে। আল্লাহর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।’
তিনি আরও বলেন, ‘হেপাটোলজি বিভাগের চিকিৎসকরা অনেক কাজ করতে চান। আমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাদেরকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করি। কাজটি সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে কার্ডিওলজি বিভাগ সহযোগিতা করেছে। তাদেরও আমি কৃতিত্ব দিবো। কারণ, কাজটা করতে গেলে ক্যাথল্যাবের সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ছাড়া হেপাটোলজি বিভাগ সুযোগ দিয়েছে।’
জায়গার অভাবে মিটফোর্ড হাসপাতালের হেপাটোলজি বিভাগে ক্যাথল্যাব স্থাপন করা যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ হাসপাতালে রোগীর জন্য জায়গা অনেক কম। আমার পরিকল্পনা ছিল হেপাটোলজিতে ক্যাথল্যাব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করবো, মন্ত্রণালয়ও রাজি ছিল, কিন্তু জায়গার অভাবে করতে পারিনি।’
ডা. কাজী মো. রশীদ-উন-নবী বলেন, ‘মাসে যদি চারজন রোগীকেও এই সেবা দিতে পারি, তাহলেও অনেক বড় ব্যাপার। এটা দেখে যদি কেউ দয়াপ্রবণ হয়ে হাসপাতালের জন্য ভবন করে দেওয়ায় এগিয়ে আসেন, তাহলে ভবিষ্যতে সম্পূর্ণরূপে হেপাটোলজি বিভাগে ক্যাথল্যাব স্থাপন করা যাবে।’
Discussion about this post