ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
২০২০ সাল থেকে প্রতি বছরই ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। যে কোনও প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় একটি সাধারণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যে কোনও কর্তৃপক্ষের জন্য ২২ বছর বেশ দীর্ঘ একটি সময়। তাহলে এই স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে এখনও আমরা পিছিয়ে আছি কেন? দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এমন অনেকগুলো চলক (ভেরিয়েবল) রয়েছে যেগুলো বাধা হিসেবে কাজ করছে।
গত দুই দশকে সারা দুনিয়ায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আট গুণ বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গুকে এখন সবচেয়ে সংকটময় মশাবাহিত ভাইরাস বলে মনে করে। বর্তমানে ১২৯টি দেশে এই সংক্রমণ রয়েছে এবং এর প্রায় সব দেশই লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার। ব্রাজিল, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও পেরু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে কলম্বিয়া, নিকারাগুয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, ভারত ও থাইল্যান্ড। এত ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও এই রোগের ৭০ শতাংশ এশিয়ার দেশগুলোতে।
একটা বিষয় আমাদের পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, ডেঙ্গু খুব শিগগিরই নির্মূল হবে না। রোগ নির্মূলের জন্য হয় একটি প্রতিরোধমূলক ভ্যাকসিন বা নিরাময়কারী ওষুধ ব্যবস্থার প্রয়োজন যা প্যাথোজেনকে মেরে ফেলতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এ দুইটির কোনোটিই নেই।
ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেরোটাইপ রয়েছে। এগুলো হলো ডিইএন-১, ডিইএন-২, ডিইএন-৩ এবং ডিইএন-৪। এক ধরনের সংক্রমণ সেই নির্দিষ্ট স্ট্রেনের বিরুদ্ধে আজীবন অনাক্রম্যতা দেয়। তবে অন্য তিনটি ধরনের ক্ষেত্রে এমন কোনও ক্রস ইমিউনিটি নেই। ফলে, ডেঙ্গুপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যক্তিরা তাদের জীবদ্দশায় চারবার এতে সংক্রমিত হতে পারে।
অন্য জটিলতা হলো, এই ভাইরাসের দুইটি হোস্ট, মানুষ এবং এডিস এজিপ্টি মশা। একটি হোস্ট থাকা প্যাথোজেন নির্মূল করা যথেষ্ট কঠিন এবং দুইটি হোস্ট থেকে অবশ্যই কঠিন প্রচেষ্টা, প্রতিশ্রুতি ও সম্পদের ব্যবহার প্রয়োজন।
তার মানে কি কোনও আশা নেই?
অবশ্যই না! বিজ্ঞান জাদুকরী; আমরা এখন নিরাপদে বলতে পারি যে, আমরা কোভিডকে পরাজিত করেছি, তাই না? ডেঙ্গুর একটি ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে রয়েছে। কিন্তু সেটি কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কেননা, শুধু এমন ব্যক্তিকে টিকা দেওয়া যেতে পারে যার ইতোমধ্যে একবার ডেঙ্গু হয়েছে। সুতরাং, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না এমন একটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবিত হয়, যা চার ধরনের ভাইরাস থেকেই সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
কোনও প্রতিকার কি নেই?
কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল নেই। তবে সংক্রমণ যদি প্রথম দিকে শনাক্ত হয় এবং লোকজন অবিলম্বে সতর্কতা অবলম্বন করে তাহলে চিকিৎসা প্রক্রিয়া খুব কঠিন কিছু নয় এবং এ সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।
তাহলে ভয় কিসের?
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে সর্বোৎকৃষ্ট মানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বহু দূরের বিষয়। যেকোনও সংক্রামক রোগ খুব দ্রুত বাড়তে পারে এবং স্বাস্থ্যসেবাকে অপ্রতুল করে ফেলতে পারে। লোকজনের দেরিতে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতাও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। ২০১৯ সালে ১৭৯ জনের তুলনায় এবছর এখন পর্যন্ত আমাদের ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাইহোক, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৪৫; যা এ বছর পর্যন্ত নথিভুক্ত করা ৩৭ হাজার ৫০০-এর চেয়ে অনেক বেশি। স্পষ্টতই, চারপাশে একটি প্রাণঘাতী ধরন বিরাজ করছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা উদ্বেগজনক। এছাড়া আক্রান্তের এই সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে অক্টোবরে, যা স্বাভাবিক নয়। কারণ আগের বছরের প্রবণতায় দেখা গেছে, বছরের এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা হ্রাসের দিকে ছিল।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, অনেকগুলো চলক (ভ্যারিয়েবল) রয়েছে এবং কোনোটিই আমাদের পক্ষে নয়। জনসংখ্যার অত্যাধিক ঘনত্ব, দ্রুত অপরিকল্পিতা নগরায়ন, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র আকারের বর্জ্য জলের আধার ডেঙ্গু প্রতিরোধবিরোধী এবং কমিউনিটির অল্প সক্রিয়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতির জন্য খাপ না খাওয়ানো, সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
বাংলাদেশের মশক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও অ্যাডভোকেসি গোষ্ঠীগুলো সব সময় সমন্বিত ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার কথা বলে আসছে। এমন কোনও কৌশলগত পরিকল্পনা নেই যা এই ভেক্টর জনসংখ্যার বিরুদ্ধে স্বল্প মেয়াদী বা দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপ নিতে গ্রহণ করা হয়েছে। মৌসুমি বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতার পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রাদুর্ভাবের অগ্রিম সতর্কবার্তার ব্যবস্থা রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবে। যা ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের মোকাবিলা ব্যবস্থাকে দ্রুত অগ্রসর করবে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুদ্র এলাকায় বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের আওতায় ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত এডিস ইজিপ্ট মশা ছেড়ে দেওয়ার ফলে সফলভাবে ওই এলাকাগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণ ৭০ শতাংশ কমিয়েছে। এই পদ্ধতিতে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত মশা ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরির ক্ষমতা হারায়, ফলে এগুলো মানুষকে আক্রান্ত করতে ব্যর্থ হয়। ছোট আকারের এই সাফল্যের পরও বিশ্বে সর্বোচ্চ ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ব্রাজিলে।
সবচেয়ে সফল গবেষণা পরিচালিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার নর্থ কুইন্সল্যান্ডে, যেখানে ওলবাচিয়া দিয়ে ডেঙ্গু একেবারে নির্মূল করা হয়েছে।
কিন্তু এই প্রকল্পটি আট বছর ধরে পরিচালিত হয়েছে এবং সেখানকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র দেড় লাখের মতো। অর্থনীতিবিদরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জনপ্রতি ১২ থেকে ২১ ডলার ব্যয় হতে পারে। বাংলাদেশও একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে। এটি আদৌ বাস্তবসম্মত হবে?
সৌভাগ্যবশত আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে (ডিজিএইচএস) একটি রিপোর্টিং সেল রয়েছে যা প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গণনা করে। এই পরিসংখ্যা ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের হটস্পটগুলো চিহ্নিত করতে সহযোগিতা করে। যা সিটি করপোরেশনকে মশক নিধন কর্মসূচির পথ নির্দেশ করে। মানুষের আচরণ পরিবর্তন করা কঠিন, ডেঙ্গুর মৌসুমে নিজেদের বাসা-বাড়ি ও এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে মানুষকে সচেতন করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত আমাদের বিশাল জনসংখ্যার কমিউনিটিতে আগাম মশক নিয়ন্ত্রণ হস্তক্ষেপই হলো সবচেয়ে ভালো। এটি একটি শহুরে রোগ, শহরের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে পদক্ষেপ নিলে সব জায়গায় আক্রান্তের হার কমিয়ে দেবে।
লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপে স্নাতকোত্তর।
Discussion about this post