অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন করাই দিনটির মূল উদ্দেশ্য়। চলতি বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের মূল প্রতিপাদ্য় ছিল ‘বিশ্বব্যাপী সবার মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।’
শারীরিক সুস্বাস্থ্য যেমন নিশ্চিত করা নিয়ে আমরা ব্যতিব্যস্ত থাকি, তেমনি মানসিকভাবে ভালো থাকার ব্যাপারটিও নিশ্চিত করা জরুরি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানসিক অসুস্থতা একা একা সারানো সম্ভব হয় না। তখন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়। মানসিক স্বাস্থ্য বা মনোরোগ বিষয়ে চিকিৎসক বা সাইকোথেরাপিস্টের শরণাপন্নের ব্যাপারটি আমাদের দেশে এখনো অবহেলিত।
আনন্দ, ভয়, রাগ, দুঃখ—জন্মগতভাবে আমাদের এই চারটি অনুভূতি রয়েছে। এগুলো প্রকাশ করতে না পারলে আমরা বিভিন্ন মানসিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যাই। তার প্রভাব পড়ে শরীরে। মানসিক অবসাদ দূর করতে প্রয়োজনে ওষুধ ব্যবহার করা যেতেই পারে। কিন্তু তা একধরনের নির্ভরশীলতা তৈরি করতে পারে। ওষুধের অনিয়ম ও অপব্যবহার অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করতে পারে। সেদিক থেকে সাইকোথেরাপি হলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত।
সাইকোথেরাপি ব্যায়ামের মতো। এটি মস্তিষ্ক সজীব করবে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে।
আমাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামক অংশ ভয় ও অনুভূতি নিয়ে কাজ করে। যাঁরা বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগছেন, তাঁদের অ্যামিগডালা ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।
অ্যামিগডালা যত বড় হবে, দুশ্চিন্তা তত বেশি হবে। সামাজিক উদ্বিগ্নতা বা সোশ্যাল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্ত যেকোনো বয়সের মানুষের অ্যামিগডালার আয়তন কমিয়ে আনতে পারে সাইকোথেরাপি।
সাইকোথেরাপি তাঁদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামের অংশটি ধীরে ধীরে সংকুচিত করে আনে। ফলে বিষণ্নতায় ভোগা মানুষের কষ্ট
কমে। আবার হিপোক্যাম্পাস নামে একটি অংশ আছে মস্তিষ্কে, যেটি আমাদের আবেগ ও স্মৃতি জমা রাখে। সাইকোথেরাপি এটিকেও ভালো রাখে।
এগুলো টেকনিক্যাল অংশ, যা একজন সাইকোথেরাপিস্ট করবেন। কিন্তু এর বাইরে রোজকার জীবনে প্রতিনিয়ত আমরা যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাই, সেখানেও কাজ আছে। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা নিজেদের আন্তসম্পর্কের দিকে খেয়াল রাখার ব্যাপারটিও কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
প্রিয়জনের সঙ্গে, নিজের সঙ্গে কিংবা পরিবারের সবার সঙ্গে ভালো সময় কাটালেও কিন্তু হ্যাপি হরমোনের নিঃসরণ বাড়ে।
বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে সম্পর্ক
পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রচুর বলতে দিন। একটা সময় পর সন্তানেরাই ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। তাই তাঁদের সঙ্গ ছাড়বেন না। পুরোনো দিনের গল্প শুনতে চান। তাঁর কিসের সমস্যা হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করুন। এমন কিছু বলবেন না, যেটা তাঁর আত্মসম্মানে লাগে। যেকোনো প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে যোগাযোগের সব ব্যবস্থা তাঁর হাতের কাছে রাখুন। তাঁর কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হয় কি না, জিজ্ঞেস করুন।
জীবনসঙ্গীর সঙ্গ
জীবনসঙ্গীর সঙ্গে দিন শেষে একই ঘরে থাকলেও তাঁর সঙ্গে দিনে ঠিক কতক্ষণ কোয়ালিটি টাইম কাটান, বলুন তো? বৈবাহিক সম্পর্ক এমন একটি সম্পর্ক, যা রোজ নতুন করে সৃষ্টি করতে হয়। তাই দিন শেষে পাশের মানুষটির খোঁজ নিন। চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। কথা শুরু হলে হাতের ফোন, টিভির রিমোট সব নামিয়ে রাখুন। সে কী বলছে, সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। একসঙ্গে দুজনই পছন্দ করেন এমন কিছু কাজ সাপ্তাহিক তালিকায় রাখুন। যেমন হাঁটতে যাওয়া, সিনেমা দেখা, বই পড়া ইত্যাদি।
কোনো প্রসঙ্গে আপনার সঙ্গে আপনার জীবনসঙ্গী বা ভালোবাসার মানুষটি আলোচনা করতে চাইলে এড়িয়ে যাবেন না। এড়িয়ে যাওয়া সম্পর্কের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
সন্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক
শিশুদের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম মানে প্রচুর কথা বলা, খেলা। কিন্তু সেটা এমন কথা হবে, যেখানে সে তার মতামত জানাতে পারবে। আলোচনায় অংশ নিতে পারবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকার পাবে।
যখন কথা শুনবেন, তখন মাঝেমধ্যে আগের শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাসঙ্গিক ছোট ছোট প্রশ্ন করুন, যাতে শিশুটি বোঝে যে আপনি খেয়াল করছেন। আপনি দিন শেষে নির্ভরযোগ্য এ বিষয়টা সন্তানের মস্তিষ্কে পোক্ত করার দায়িত্ব আপনারই। কারণ আন্তসম্পর্ক যত ভালো থাকবে, মানসিক স্বাস্থ্যও তত ভালো থাকবে।
লেখক: চিকিৎসক ও সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা
Discussion about this post