ডা. ছাবিকুন নাহার
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া কী?
প্লাসেন্টা হলো গর্ভফুল, যার মাধ্যমে বাচ্চা জরায়ুর সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। গর্ভফুলের অবস্থান থাকে সাধারণত জরায়ুর ভেতরে ওপরের দিকে। এই গর্ভফুল কোনো কারণে যদি জরায়ুর নিচের দিকে থাকে তখন তাকে বলে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া।
মায়ের সঙ্গে বাচ্চার সংযোগ হচ্ছে এই ফুল এবং এটির নালি।
বাচ্চা জন্ম হওয়ার এক সেকেন্ড আগ পর্যন্ত গর্ভে সন্তানের জন্য খাদ্য, পুষ্টি, অক্সিজেন সব নিশ্চিত করে এই দুটি। বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার পর গর্ভফুলের কাজ শেষ হয়। এরপর গর্ভফুল জরায়ু থেকে আলাদা হয়ে ডেলিভারি হয়। কিন্তু প্লাসেন্টা প্রিভিয়া এই ফর্মুলা মানে না।
প্রেগন্যান্সির শেষের দিকে ডেলিভারি প্রসেসের অংশ হিসেবে জরায়ুর নিচের অংশ স্ফীত হতে শুরু করে। এটি হবেই। বিপদ হচ্ছে, গর্ভফুল জরায়ুর নিচে অবস্থান করলে বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার আগেই জরায়ু স্ফীত হওয়ায় গর্ভফুল আলাদা হতে শুরু করে! ফলাফল রক্তের বন্যায় ভেসে যান মা। চাপ চাপ রক্ত! তাজা তাজা লাল লাল! এদিকে রক্তশূন্যতায় মা শকে যান, ত্বরিত ব্যবস্থা না নিলে মরেও যান। মা মরে গেলে বাচ্চা কি আর বেঁচে থাকে?
এত কিছু কিন্তু ঘটে কোনো রকম ব্যথা-বেদনা ছাড়াই। রোগী হয়তো ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুম থেকে জেগে দেখেন তাঁর বিছানা-বালিশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে অথচ কোনো ব্যথা নেই।
কেন এমন হয়
প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার কারণ তেমন জানা যায় না। তবে আগে সিজারিয়ান সেকশনের হিস্ট্রি থাকলে হতে পারে। আরো আছে এমআর, ডিঅ্যান্ডসি, স্মোকিং, বেশি বয়সে বাচ্চা নেওয়া, বেশি বাচ্চা নেওয়া, যমজ বাচ্চা ইত্যাদি।
প্রেগন্যান্সির শেষের দিকে সাধারণত ২৮ সপ্তাহের পর কোনো কারণ ছাড়া, ব্যথা-বেদনা ছাড়া যখন-তখন মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে মূল লক্ষণ। আলট্রাসাউন্ড করলে দেখা যায়, গর্ভফুল জরায়ুর লোয়ার সেগমেন্টে অবস্থান করছে। রক্তপাত ছাড়াও রুটিন আলট্রাসাউন্ড করলেও ডায়াগনসিস করা যায়।
জটিলতা
রক্তক্ষরণ : প্রেগন্যান্সি, ডেলিভারি এবং ডেলিভারির পর যত রক্তক্ষরণ হয় তার অন্যতম কারণ প্লাসেন্টা প্রিভিয়া।
প্লাসেন্টা একরিটা : জরায়ুর ভেতরে ফুল এমনভাবে আটকে থাকে যে ফুল ডেলিভারি হয় না। ফলে মাকে বাঁচাতে জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয় অনেক সময়।
প্রসব-পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণে মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ প্লাসেন্টা প্রিভিয়া।
চিকিৎসা
প্লাসেন্টা প্রিভিয়া হলে অবশ্যই বাচ্চা সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে ডেলিভারি করাতে হবে। এই অপারেশন আবার যেখানে-সেখানে করানো যাবে না। যেসব হাসপাতালে আইসিইউ, এনআইসিইউ সাপোর্ট আছে, ২৪ ঘণ্টা সিজারিয়ান সেকশন আছে—এমন জায়গায় ডেলিভারি করাতে হবে। কমপক্ষে চার ব্যাগ ক্রস ম্যাচ রক্ত এবং ১০ জন ডোনার রেডি রাখতে হবে।
অভিজ্ঞ সার্জন, অভিজ্ঞ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট এবং অভিজ্ঞ ডাক্তার, নার্সিং টিম সাপোর্ট লাগবে। রোগীর কাছের মানুষদের সব কিছ বুঝিয়ে যথাযথভাবে কাউন্সেলিং করতে হবে। বেস্ট হাসপাতাল সেটআপ, সেরা সার্জন টিম, সেরা সাপোর্ট টিম নিয়ে দিনের প্রথম কেস হিসেবে অপারেশন করতে হয়। তার পরও যেকোনো পরিস্থিতির জন্য রেডি থাকতে হবে।
আশার কথা হচ্ছে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি, সনোগ্রাফির সহজলভ্যতা, মানুষের সচেতনতা, ডাক্তারদের যৌক্তিক কর্মনিষ্ঠতা ও সক্ষমতার জন্য এই মৃত্যুগুলো অনেকাংশেই কমানো সম্ভব হচ্ছে। সচেতনতা বাড়লে আরো কমে আসবে।
লেখক : গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনি রোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা
Discussion about this post