অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী
শরৎ এল। প্রভাতে প্রকৃতির প্রসন্ন মূর্তি। রোদে নতুন উত্তাপ। শীতল বাতাসে ভাসে পরাগ রেণু। আর এমন অনিন্দ্য সুন্দর শরতেও রোগবালাই হানা দেয়। এ ঋতুর অসুখের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যাজমা বা হাঁপানি। সকালবেলা ঘাসের ওপর শিশির বিন্দু দেখার লোভে ঘর থেকে বাইরে দুই পা ফেলার পর কাশি, সর্দি আর হাঁপ ধরা জেঁকে বসে। এর ফলে সারা রাত ঘুম না হওয়া, বুকে সর্দি জমা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। শরতের শীতল ও শুষ্ক বাতাস উসকে দেয় এ রোগ।
ফুসফুসের এই রোগে বারবার বুকে শোঁ শোঁ শব্দ, শ্বাসকষ্ট, বুক আঁটসাঁট ভাব, রাতে বা খুব সকালে কাশি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। একে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় ওষুধ খাওয়ার মাধ্যমে। এ ছাড়া যেসব কারণে এ সমস্যা আরও বাড়ে সেগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। যেমন এই ঋতুর গরম-ঠান্ডা আবহাওয়ায় শ্বাস নেওয়া কষ্টকর। আর বায়ুদূষণ তো আছেই।
হাঁপানি অনেক ক্ষেত্রে জিনগত রোগ। পরিবারে কারও থাকলে হাঁপানি হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে অনেকটা। ইদানীং সমগ্র পৃথিবীতে বায়ুদূষণ বাড়ায় প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা। আমাদের দেশে হাঁপানি একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য সমস্যা। আনুমানিক ৭০ লাখ লোক এতে আক্রান্ত; তার মধ্যে ৪০ লাখ শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের উপাত্ত বলছে, দেশে হাঁপানিতে মৃত্যু হয়েছে ৮ হাজার ৮৯৩ জনের।
অ্যাজমা অ্যাটাকের কারণ
- অ্যালার্জেন, যেমন পরাগ রেণু, পশুর লোম, ধুল পোকা, ধোঁয়া ইত্যাদির সংস্পর্শে আসা।
- বায়ুদূষণ।
- আইবোপ্রফেন ওষুধের প্রভাব।
দূষণে শ্বাসনালিতে প্রদাহ হয়। ফুসফুসে বাতাস ঢোকার পথগুলো সরু হয়ে যায় এবং ফুলে ওঠে। পাশাপাশি জমতে থাকে মিউকাস। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শুরুতে সাধারণ শ্বাসকষ্ট হয়, পরে তা গুরুতর পর্যায়ে চলে যায়।
লক্ষণ
ব্যক্তিভেদে হাঁপানির লক্ষণ ভিন্ন হয়। এর মধ্যে আছে
- অল্পেই হাঁপ ধরে যাওয়া
- বুকে ব্যথা ও চাপ চাপ ভাব
- শ্বাসকষ্টে রাতে ঘুমাতে না পারা
- রাত বাড়ার সঙ্গে কাশি বেড়ে যাওয়া
- অনবরত হাঁচি হওয়া
- চোখে জ্বালা করা
- চোখ দিয়ে পানি পড়া
- শ্বাস নেওয়া আর ছাড়ার সময় শোঁ শোঁ শব্দ হওয়া।
যেসব কারণে হাঁপানি হয়
- ফ্লু ও নিউমোনিয়াজাতীয় শ্বাসনালির অসুখের
- ইতিহাস থাকলে হতে
- পারে হাঁপানি
- পেশাগত কারণে রাসায়নিক, ধোঁয়া, ধুলা, গ্যাসের সংস্পর্শে দীর্ঘ সময় থাকা
- বাতাসের দূষণ
- রাসায়নিক বা বিশেষ গন্ধ সহ্য করতে না পারা
- বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের পরাগ রেণু, পোকামাকড়, খাবারদাবার যেমন চিংড়ি, ইলিশ, বেগুন, ধুলা, পোষ্যের লোম, লালা, কোমল পানীয় পান ইত্যাদি থেকে হতে
- পারে অ্যালার্জি। সেখান থেকেও হাঁপানি হতে পারে।
- পরিবারে কারও হাঁপানি থাকলে হাঁপানি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
মোকাবিলা
- যেসব থেকে অ্যালার্জি হয়, সেসব থেকে দূরে থাকা
- চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা
- নিয়মিত শিশুদের শারীরিক পরীক্ষা করানো
- ফুসফুসের স্পাইরোমেটরি পরীক্ষা
- অ্যালার্জি পরীক্ষা
চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণ
চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া। অ্যাজমার ওষুধ দুই রকম—দ্রুত উপশমকারী ও দীর্ঘমেয়াদি উপশম। হাঁপানির চিকিৎসা হয় তিন ধাপে—
- শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম
- ফার্স্ট এইড চিকিৎসা
- দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ
দীর্ঘমেয়াদি হলে বেশ কিছু সময় ইনহেলার ও নেবুলাইজার ব্যবহার করতে হতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শে। ইনহেলার হতে পারে গুঁড়ো বা অ্যারোসলজাতীয়। রিলিভার ইনহেলার হয় নীল রঙের।
মনে রাখা দরকার
- হাঁপানি সারে না, কিন্তু চেষ্টা করলে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
- হাঁপানি থাকলে ঋতু বদলের সময় সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শরৎ ও বসন্তে বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
- পশুর লোমে অ্যালার্জি হলে, তা থেকে দূরে থাকুন।
- যে খাবারে অ্যালার্জি হয় সেগুলো বাদ দিন।
- ঠান্ডার সমস্যা থাকলে সঙ্গে রাখুন গরম পোশাক।
- ব্যাগে ইনহেলার রাখতে হবে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য।
- হাঁপানি হলে অল্প পরিমাণে সরিষার তেল হাতের তালুতে নিয়ে বুকে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্টিম বাথ
কাজে দেয়। - যেকোনো ধরনের ধোঁয়া থেকে দূরে থাকুন।
লেখক- অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী,সাবেক অধ্যক্ষ ,চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
Discussion about this post