হার্টবিট ডেস্ক
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কিট উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ভাবিত এ আরটিপিসিআর কিটে মাত্র ২৫০ টাকায় শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা যাবে।
উদ্ভাবন বিষয়ে জানাতে আজ সোমবার (৭ আগস্ট) বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
এটিকে অভাবনীয় আবিষ্কার উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আফতাব আলী শেখ বলেন, ‘আগে করোনা কিটগুলে বিদেশ থেকে কিনে আনতে হতো। এতে করে দেশের অনেক অর্থ খরচ হতো। এখন থেকে আমাদের দেশে তৈরি হবে। তাই দেশের অর্থ দেশেই থাকছে।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ‘দেশের ঐতিহ্যবাহী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিসিএসআইআর দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে শিল্প ও বিজ্ঞান বিষয়ে নানাবিধ উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও গবেষণায় অনন্য অবদান রেখে চলেছে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা আজ একটি সময়োচিত উদ্ভাবনের সুসংবাদ নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি; যা থেকে করোনা মহামারি প্রাদুর্ভাবের এই দুঃসময়ে আমরা সকলেই উপকৃত হবো।’
বক্তারা বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার নিয়ন্ত্রণের জন্য দ্রুত ও নির্ভুল শনাক্তকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারি এখনো চলমান এবং বাংলাদেশে এ পর্যন্ত প্রায় ১,৩১,৫৮,৭৬৪ সংখ্যক মানুষের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক শনাক্তকরণ কিট সম্পূর্ণটাই আমদানি করতে হয়, যা আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এ ছাড়া করোনা ভাইরাস ঘনঘন তার জিনগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার ফলে বাণিজ্যিক কিটগুলোর শনাক্তকরণ Sensitivity ও Specificity হ্রাস পাচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে ভুল ফলাফল (False negative) দিতে পারে। SARS-CoV-2 শনাক্তকরণে qRT-PCR টেস্টকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বর্তমানে যে qRT-PCR কিট ব্যবহৃত হচ্ছে তা অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ, প্রতিটি পরীক্ষায় ব্যয় হয় আনুমানিক ৩০০০-৩৫০০ টাকা। কোভিডকালীন সংকটময় মুহূর্তে দেশবাসী তথা কোভিড রোগীদের সহায়তার জন্য বিসিএসআইআর’র নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় একটি qRT-PCR কিট ‘BCSIR-CoVID Kit’ উদ্ভাবিত হয়েছে, যা কোভিড-১৯-এর শনাক্তকরণের জন্য একটি সহজ এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতি। এই কিটের ন্যূনতম শনাক্তকরণ ক্ষমতা (Limit of Detection, LoD) ১০০ কপি ভাইরাস/মি.লি., যেখানে অন্যান্য আমদানিকৃত কিটগুলোর LOD ১০০০ কপি ভাইরাস/মি.লি.।
অর্থাৎ BCSIR-COVID Kit দ্বারা একেবারেই ন্যূনতম সংখ্যক ভাইরাসকেও শনাক্ত করা যাবে। ফলে রোগের উপসর্গ প্রকাশের আগেই ভাইরাসের উপস্থিতি জানা সম্ভব হবে।
এতে আরও জানানো হয়, কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার জন্য প্রাইমার এবং প্রোবের টাগের্ট সিকুয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের অন্যান্য বাণিজ্যিক কিটে S, N, ORF1ab জিন ব্যবহার করা হয়। এসব জিনের মধ্যে সহজে মিউটেশন ঘটতে পারে, যা False negative রেজাল্টের আশঙ্কা বৃদ্ধি করে। পক্ষান্তরে, BCSIR-COVID Kit এ ‘M’ জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এই জিনটিতে অন্যান্য জিনের মতো মিউটেশন ঘটার প্রবণতা কম। তাই এই কিটে False negative ফলাফলের আশঙ্কা কম এবং ফলাফল বিশ্লেষণ করা তুলনামূলক সহজ ও যথাযথ। এ কিটের জন্য টার্গেটকৃত প্রাইমার ও প্রোবে বিসিএসআইআর’র বিজ্ঞানীগণ নিজস্ব গবেষণাগারে ডিজাইন করেছেন। তাই এই কিটটি অন্য বাণিজ্যিক কিটের তুলনায় স্বতন্ত্র। ভাইরাস শনাক্তকরণের জন্য RNA extraction একটি ব্যয়বহুল ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মূলতঃ এ কারণেই বাণিজ্যিক কিটগুলাের খরচ বৃদ্ধি পায়।
বক্তারা বলেন, বিসিএসআইআর অত্যন্ত স্বল্প ব্যয়ে RNA extraction-এর পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। তাই BCSIR-COVID Kit দ্বারা প্রতিটি শনাক্তকরণ পরীক্ষায় খরচ হবে মাত্র ২৫০ টাকা। তুলনামূলক পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, BCSIR-COVID Kit-এর Specificity, Sensitivity এবং Accuracy গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড কিটের সমকক্ষ ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কিটগুলোর থেকে উন্নতমানের। তাই Bangladesh Medical Research Council (BMRC) ইতোমধ্যে এটিকে এথিক্যাল ক্লিয়ারেন্স প্রদান করেছে। বর্তমানে এই কিট Directorate General of Drug and Administration (DGDA) কর্তৃক Performance Evaluation Study-এর জন্য অনুমোদিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য নিজেদের উদ্ভাবিত কিটকে সহজ এবং সাশ্রয়ী পদ্ধতি উল্লেখ করে তারা বলেন, দেশের ঔষধশিল্পে জড়িত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্রুত এই কিট উৎপাদনে গেলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের জনগণ অত্যন্ত উপকৃত হবে। এক্ষেত্রে বিসিএসআইআর’র সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীগণ কারিগরি সহায়তা প্রদানে সবর্দা তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস অব্যাহত রাখবেন।
অনুষ্ঠানো জানানো হয়, বিশ্বে বর্তমান সময় পর্যন্ত আবির্ভূত সংক্রামক রোগসমূহের মধ্যে কোভিড-১৯ সর্বাপেক্ষা দ্রুত বিস্তারী ও প্রাণসংহারী ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে আবির্ভাবের পর থেকে এ পর্যন্ত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৫৮ কোটি ৫২ লাখের অধিক মানুষ; যার মধ্যে প্রায় ৬৪ লাখ ২৭ হাজার মৃত্যুবরণ করেছে। সরকারি তথ্য মতে, এ পর্যন্ত (৪ অগাস্ট) দেশে ২০ লাখ ৬ হাজার ৩৬৮ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং এর ফলে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৯ হাজার ২৯৮ জন।’
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসএমএমইউ ভাইস চ্যান্সলর (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ আতিউর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয় অধ্যাপক রফিকুল আহসান।
Discussion about this post