হার্টবিট ডেস্ক
বিশ্বে হাজার বছর ধরেই আঙ্গুর ফলের চাষ হয়ে আসছে। প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান ও এন্টিঅক্সিডেন্ট সম্পন্ন এ ফল প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের নানা রোগ প্রতিরোধ সহায়তা প্রদান করে থাকে। তাছাড়া আঙ্গুরে থাকা বি ভিন্ন ভিটামিন, খনিজ উপাদান, ম্যাংগানিজ ও পটাশিয়াম বিভিন্ন জটিল রোগ; বিশেষ করে- ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা, হৃদরোগসহ কোষ্ঠকাঠিন্য, ত্বক ও প্রদাহ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আঙুর ফলটি দ্রাক্ষালতা প্রজাতির ফল। দ্রাক্ষালতা গাছটি ভিটাসিয়া পরিবারের অন্তর্গত। লতা জাতীয় এ ফলটির এক থোকায় ৬ হতে প্রায় ৩০০টি পর্যন্ত আঙ্গুর ধরে থাকে। আঙ্গুর কালো, নীল, সোনালী, সবুজ, বেগুনি, লাল ও সাদা হতে পারে। পাকা আঙুর সরাসরি খাওয়া হয়। তাছাড়া এ ফল দিয়ে জুস, জেলি, মদ এবং বীজ দিয়ে তেল তৈরি করা হয়। এমনকি আঙ্গুর শুকিয়ে কিসমিস তৈরি হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, এক কাপ (১৫১ গ্রাম) লাল কিংবা সবুজ আঙ্গুরে ১০৪ ক্যালোরি, ২৭ গ্রাম শর্করা, ১ গ্রাম প্রোটিন, ০.২ গ্রাম চর্বি ও ১.৪ গ্রাম ফাইবার রয়েছে। এছাড়া এ ফলে তামা দৈনিক মূল্যের ২১%, ভিটামিন কে ১৮%, থায়ামিন (ভিটামিন বি১) ৯%, রিবোফ্লাভিন (ভিটামিন বি২) ৮%, ভিটামিন বি৬ ৮%, পটাসিয়াম ৬%, ভিটামিন সি ৫%, ম্যাঙ্গানিজ ৫% ও ভিটামিন ই ২% পাওয়া যায়।
ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অফ হেলথ-এর গবেষণা বলছে, আঙ্গুরে থাকা তামা একটি অপরিহার্য খনিজ, যা দেহে শক্তি উৎপাদনে জড়িত। এছাড়া ভিটামিন কে রক্ত জমাট বাঁধার পাশাপাশি সুস্থ হাড় গঠনে সহায়তা করে। অন্যদিকে আঙ্গুরে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন এবং ভিটামিন বি৬ ভালো পরিমাণে পাওয়া যায়। যেখানে থায়ামিন ও রিবোফ্লাভিন উভয়ই বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। আবার ভিটামিন বি৬ প্রোটিন বিপাকে সহায়তা করে। এছাড়াও নিম্ন ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অফ হেলথ-এর গবেষণা অনুসারে আঙ্গুরের বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা তুলে ধরা হলো-
হার্টের সুস্থ্যতা
নিয়মিত আঙ্গুর সেবনে হার্ট ভালো থাকে। কেননা এ ফলে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান উচ্চ রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল উভয় কমাতে সহায়তা করে। গবেষণার তথ্যমতে, আঙ্গুরে থাকা পটাশিয়াম দেহে শিরা ও ধমনী প্রসারিত করণের মাধ্যমে রক্তের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখে।
অন্যদিকে আঙ্গুরে পাওয়া যৌগগুলি কোলেস্টেরল শোষণ হ্রাস করে উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। উচ্চ কোলেস্টেরলসহ ৬৯ জন লোকের ৮-সপ্তাহের গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক ৩ কাপ (৫০০গ্রাম) লাল আঙ্গুর খাওয়া লোকদের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গেছে। তবে সাদা আঙ্গুরের একই প্রভাব ছিল না।
ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস
আঙ্গুরে ক্যান্সার বিরোধী প্রভাব রয়েছে। কারণ আঙ্গুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি নির্দিষ্ট ধরণের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, এ ফলে থাকা রেসভেরাট্রোল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং শরীরে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়। এছাড়া আঙ্গুরে রয়েছে কোয়ার্সেটিন, অ্যান্থোসায়ানিন এবং ক্যাটেচিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলি সরাসরি ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। টেস্ট-টিউব এবং প্রাণীজ গবেষণা দেখা গেছে, আঙ্গুরের নির্যাস মানুষের কোলন এবং স্তন ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধিতে রাঁধা প্রদান করতে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
নিয়মিত আঙ্গুর খেলে ডায়াবেটিস ও রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, আঙ্গুরে থাকা যৌগ রেসভেরাট্রল শরীরের ইনসুলিন ব্যবহার ক্ষমতা উন্নত করে ও ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া কোষের ঝিল্লিতে গ্লুকোজ রিসেপ্টরের সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষগুলিকে রক্ষা করে। যার ফলে দেহে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়।
চোখের জন্য উপকারী
নিয়মিত আঙ্গুল খাওয়া চোখের জন্য উপকারী। কারণ আঙ্গুরে থাকা উদ্ভিদ যৌগগুলি বিশেষ করে; রেসভেরাট্রল, লুটেইন এবং জেক্সানথিন — যা চোখের সাধারণ রোগ প্রতিরোধে সাহায়তা করে।
ইঁদুরের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত আঙ্গুর খাওয়া ইঁদুরের চোখের রেটিনার কার্যক্ষমতা অন্যদের তুলনায় বেশি ছিল। তাছাড়া টেস্ট-টিউব গবেষণায় দেখা যায়, রেসভেরাট্রল মানুষের চোখের রেটিনা কোষকে অতিবেগুনী আলো থেকে রক্ষা করে এবং বয়স-সম্পর্কিত চোখের রোগ ম্যাকুলার ডিজেনারেশনের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে।
স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ ও মেজাজ ভারসাম্যে
নিয়মিত আঙ্গুর খেলে স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ এবং মেজাজ উন্নত সাধিত হয়। কেননা এতে থাকা রেসভেরাট্রল মস্তিষ্কের প্রদাহ কমানোর পাশাপাশি অ্যামাইলয়েড-বিটা পেপটাইড অপসারণ করে আলঝেইমার রোগ থেকে রক্ষা করে।
১১১ সুস্থ বয়স্ক ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ১২ সপ্তাহের গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন ২৫০ মিলিগ্রাম একটি আঙ্গুরের সম্পূরক গ্রহণ করার ফলে তাদের মনোযোগ, স্মৃতি এবং ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া সুস্থ তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, 230 মিলি আঙ্গুরের রস পান করার ২০ মিনিট পরে মেজাজ এবং স্মৃতি-সম্পর্কিত দক্ষতার গতি উভয়ই উন্নত হয়েছে। অন্যদিকে ইঁদুরের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৪ সপ্তাহের রেসভেরাট্রল গ্রহণের ফলে স্মৃতিশক্তি ও শেখার আগ্রহের পাশাপাশি মেজাজ ভারসাম্যের উন্নত হয়েছে।
হাড়ের মজবুতি
আঙ্গুর খেলে হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নতি হয়। কেননা আঙ্গুরে থাকা ভিটামিন ও খনিজ হাড়ের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে। গবেষণার পাওয়া তথ্যমতে, আঙ্গুরে হাড়ের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় অনেক পুষ্টি উপাদান বিশেষ করে- খনিজ পটাসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং ভিটামিন বি, সি এবং কে রয়েছে। যা অস্টিওপরোসিসের পাশাপাশি পোস্ট মেনোপজ মহিলাদের হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সহায়তা করে।
ইঁদুরের উপর ৮ সপ্তাহের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ইঁদুরকে হিমায়িত-শুকনো আঙ্গুরের গুঁড়া খাওয়ানোর ফলে হাড়ের শোষণ এবং ক্যালসিয়াম ধারণ ক্ষমতা ভালো ছিল। অপরদিকে পোস্টমেনোপজাল মহিলাদের উপর ২-বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন দুবার ৭৫ মিলিগ্রাম রেসভেরাট্রল হাড়ের খনিজ ঘনত্ব উন্নত করে ও হাড়ের ক্ষয় কমায়। এমনকি বড় ফ্র্যাকচার ও হিপ ফ্র্যাকচারের ঝুঁকি হ্রাস করে।
ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক থেকে রক্ষা
আঙ্গুরের বেশ কিছু যৌগ ক্ষতিকারক অণুজীবের বিরুদ্ধে লড়াই করে। কেননা রেসভেরাট্রল-এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ক্যাম্পিলোব্যাক্টর জেজুনি এবং ক্যান্ডিডা অ্যালবিকানস বৃদ্ধিকে বাঁধা দেয়। এছাড়াও খাদ্যজনিত অসুস্থতা ই-কোলি নিয়ন্ত্রণ করে। এমনকি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল যৌগের মধ্যে অ্যান্থোসায়ানিন উপাদান রয়েছে, যা ব্যাকটেরিয়া কোষের দেয়ালকে ধ্বংস করতে পারে।
বার্ধক্য হ্রাস
নিয়মিত আঙ্গুর খেলে দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া রোধ হয়। ফলে বার্ধক্য হ্রাস পায়। কারন আঙ্গুরে থাকা রেসভেরাট্রল বার্ধক্য রোধ করার পাশাপাশি তারুণ্য উদ্দীপক জিনকে সক্রিয় করে।
গবেষণায় দেখা যায়, রেসভেরাট্রোল ক্যালোরি সীমাবদ্ধতার উপকারী প্রভাবগুলি অনুকরণ করে বার্ধক্যের লক্ষণগুলিকে বিলম্বিত করতে পারে, যেমন অক্সিডেটিভ স্ট্রেস হ্রাস করা, স্ট্রেস প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া উন্নত করা।
প্রদাহ হ্রাস
আঙ্গুরে প্রদাহ-বিরোধী যৌগ রয়েছে, যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ থেক দেহকে রক্ষা করে। যদিও নিম্ন স্তরের প্রদাহ একটি সাধারণ শারীরিক প্রতিক্রিয়া। তবে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ; বিশেষ করে- ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস এবং অটোইমিউন রোগ দেহের বিকাশে এক জটিল বাঁধা। কিন্তু আঙ্গুরে থাকা অ্যান্থোসায়ানিন এবং রেসভেরাট্রল যৌগগুলি শক্তিশালী প্রদাহ-বিরোধী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ফলে এসব রোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
গবেষণা দেখা যায়, উভয় যৌগ টিউমার নেক্রোসিস ফ্যাক্টর-আলফা এবং ইন্টারলেউকিন-৬ এর মতো প্রদাহজনিত রোগ দমন সহায়তা করে।
ত্বক ও চুলের যত্নে
ত্বক ও চুলের যত্নে আঙ্গুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।কারণ আঙ্গুরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রেসভেরাট্রল ত্বককে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং চুলের বৃদ্ধিকে তরান্বিত করে।
প্রাণীদের গবেষণা দেখা গেছে, কোলাজেন উৎপাদনে রেসভেরাট্রোলের প্রভাবে দ্রুত ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে। তাছাড়া এ যৌগটি ত্বকের বাঁধা ভেদ করে এবং কোলাজেনের ঘনত্ব বাড়ায়। এমনকি সূর্যের এক্সপোজার থেকে ত্বককে রক্ষা করতে সহায়তায় করে।
কোষ্টকাঠিন্য দূর করে
নিয়মিত আঙ্গুর খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পরিত্রাণ লাভ করা যায়। কারণ পানি ও ফাইবারের ভালো উৎস হিসেবে আঙ্গুর কোষ্ঠকাঠিন্য উপশম করতে সহায়তায় করে। মূলত খাদ্যতালিকায় ফাইবার ও পরিমাণ মতো তরল না থাকলে ডিহাইড্রেশনের সম্ভাবনা বেশি থাকে। আর কোষ্ঠকাঠিন্যের অন্যতম কারণ ডিহাইড্রেশন।
গবেষণা বলছে, আঙুরে থাকা ফাইবার কোলন দিয়ে মল সরাতে সময় কমাতে সহায়তা করে। এমনকি মলকে নরম করে মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। তাছাড়া আঙ্গুরে থাকা ৮১% পানি দেহকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে।
তথ্য সূত্র: হেলথ লাইন
Discussion about this post