হার্টবিট ডেস্ক
মস্তিষ্কের অন্যতম প্রধান স্নায়ুজনিত সমস্যা হলো অটিজম। এটিকে শিশুদের নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা রোগটির প্রকৃত কোনো কারণ উদঘাটন করতে পারেননি। তবে চিকিৎসকরা মনে করেন, অটিজম জিনগত এবং পরিবেশগত কিছু কারণে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রোগটি নিয়ে সরকারি জরিপের তথ্য বলছে, ১০ বছর আগের তুলনায় দেশে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু বেড়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুর সংখ্যাই বেশি। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে এ রোগের হার বেশি বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্টিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজমের (ইপনা) চার বছর আগের তথ্য বলছে, প্রাপ্ত বয়স্কদের বাদেই দেশে তিন লাখের বেশি অটিজম আক্রান্ত শিশু রয়েছে। বর্তমানে সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। যাদের বয়স দেড় থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
২০১৩ সালে দেশে অটিজম শিশুদের অবস্থা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে প্রথম একটি জরিপ চালায় ইপনা। যেখানে প্রতি ১০ হাজার শিশুর মধ্যে ১৫ জন শিশু অটিজম বহন করে বলে উঠে আসে। চার বছর পর ২০১৭ সালে আরও একটি জরিপ পরিচালনা করে সংস্থাটি। যেখানে দেখা যায়, ১০ হাজারে ১৭ জন শিশু বিশেষ এ বৈশিষ্ট্যের। প্রতিবেদনে ঢাকা শহরেই শতকরা তিন জন আর গ্রামে প্রতি সাতশ জনে একজন বাচ্চা অটিস্টিক বলে উঠে আসে।
এদিকে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রকৃত তথ্য জানতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি জরিপ চলছে। সেখানে এখন পর্যন্ত দেশে ৬৬ হাজার অটিস্টিক শিশু নিবন্ধন করেছে বলে জানা গেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে, হাসপাতালটির শিশু নিউরোলজি বিভাগে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দুইশ অটিজম শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। সে হিসেবে নতুন-পুরাতন মিলিয়ে প্রতি মাসে প্রায় ৩০ হাজারেরও বেশি অটিজমে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিতে আসে। জানা গেছে, বিএমএমএমইউ ছাড়াও সারা দেশের ৩৪টি মেডিকেলে অটিজমে আক্রান্তদের চিকিৎসায় একটি করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র রয়েছে। এর বাইরে অটিজম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও প্রয়াসসহ আরও বহু প্রতিষ্ঠান বেসরকারিভাবে কাজ করছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অটিজম মনিটরিং সেলের পরিচালক ও বিএসএমএমইউ হাসপাতালের শিশু নিউরোলজি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, দেশে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) তথ্য বলেছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতি ৫৪ জনে একজন শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে চলমান একটি জরিপে এখন পর্যন্ত দেশে ৬৬ হাজার অটিস্টিক শিশু নিবন্ধন করেছে। এর আগে দেশে দুটি জরিপ হয়, একটি ২০১৩ সালে অপরটি ২০১৭ সালে।
২০১৩ সালের জরিপে দেখা যায় দেশে প্রতি ১০ হাজার জনে ১৫ জন শিশু এবং ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনে ১৭ জন এ রোগে আক্রান্ত। তবে দুটি জরিপেই মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুর সংখ্যা বেশি ছিল। একই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহর অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, বলেন তিনি।
ডা. গোপেন কুমার কুন্ডু বলেন, দেড় বছর থেকে তিন বছরের শিশুদের এ রোগ হয়ে থাকে। এটি একটি জেনেটিক ডিজঅর্ডার, যা সাধারণত দেড় বছর থেকে অল্প করে অটিজমের নানা বৈশিষ্ট্য আসা শুরু করে এবং তিন বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণরূপে আসে। কিন্তু শুরুর এক বছরের একটি শিশু একটু একটু কথা বলে, দাঁড়ায় ও হাঁটে। অর্থাৎ এক বছর পর্যন্ত শিশুটি ভালোই থাকে, তবে দেড় বছর বয়সে গিয়ে শিশুটি আগের মতো হাঁট-চলা ঠিকমতো করলেও কথাবার্তা আর আচার-আচরণে সমস্যা শুরু হয়। তিন বছর বয়সে অটিস্টিক শিশুর সমস্ত আচার-আচরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, অটিজম একটি নিউরো ডিজঅর্ডার ডেভেলপমেন্ট (স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা)।
তিনি আরও বলেন, অনুন্নত দেশের তুলনায় উন্নত দেশে অটিজম আক্রান্ত শিশুর হার অনেক বেশি। আমাদের দেশেও গ্রামের তুলনায় ঢাকা শহরে অটিজম আক্রান্ত শিশু অনেক বেশি। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চবিত্ত পরিবার ও ছোট একক পরিবারে মধ্যে বেশি। আবার এ রোগটি মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে বেশি। ছেলে ও মেয়ের মধ্যে এর অনুপাত হলো ৪ : ১। অর্থাৎ চার জন ছেলের বিপরীতে একজন মেয়ে অটিজমে আক্রান্ত।
চিকিৎসা প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক বলেন, অটিজম রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব নয়। অটিজম শিশুদের জন্য যে চিকিৎসা প্রয়োজন তা হলো— ব্যবহারিক চিকিৎসা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ দিয়েও চিকিৎসা হয়ে থাকে। এ ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক যথেষ্ট কিন্তু এ রোগগুলোর কিছু ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য একজন সাইকোলজিস্টের প্রয়োজন হয়, একজন স্পিচ থেরাপিস্টের প্রয়োজন হয়। এ শিশুদের শিক্ষার জন্য এবং ব্যবস্থাপনার জন্য তাদের একটি বিশেষ স্কুলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে অটিজম আক্রান্তের তুলনায় স্কুলের পরিমাণ অনেক কম।
এ বছর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশব্যাপী দিবসটি উদযাপন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকায় বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে। অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তর-সংস্থা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারি গুরুত্বপূর্ণ ভবনে নীল রঙের আলোকসজ্জা করা হবে। এছাড়া অটিজম বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে রোড ব্র্যান্ডিং, বিশেষ স্মরণিকা ও লিফলেট ছাপানো হয়েছে।
অটিজমে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্কদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৭ সালে ২ এপ্রিলকে ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
এক সময় অটিজম ছিল একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। এ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র কন্যা ও স্কুল সাইকোলজিস্ট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ২০০৭ সালে এ বিষয়ে দেশে কাজ শুরু করেন। সায়মা ওয়াজেদ এ অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে তার বিরাট অবদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছেন।
Discussion about this post