ডা. মোরশেদা চৌধুরী
বর্তমানে বেসরকারি কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের বিশ্বের সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্কটি গড়ে উঠেছে ব্র্যাকের উদ্যোগে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, যে দেশে নারীদের এখনও স্বনির্ভরতা অর্জন ও অবাধে চলাফেরার পূর্ণ অধিকার অর্জিত হয়নি সে দেশে আমাদের ৫০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীর সবাই নারী। এই অসম্ভব ঘটনাটি কীভাবে সম্ভব হলো?
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য কর্মসূচি শুরু হয়েছিল পাঁচ দশক আগে সুনামগঞ্জ জেলার দুর্গমতম শাল্লা উপজেলায় চারটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কেন্দ্রগুলোতে চিকিৎসকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীরাও ছিলেন। তারা সবাই ছিলেন পুরুষ। ভালোভাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন তারা। স্থানীয় মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যায় ভালোভাবে সেবা দিতে সক্ষম ছিলেন তারা। কিন্তু শিগগিরই ব্র্যাক বুঝতে পারে তারা ওই এলাকার নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারছেন না। বিষয়টির গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেলো সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাধার কারণে স্থানীয় নারীরা পুরুষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছ থেকে সেবা নিতে আসছেন না। তার ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই– স্বাস্থ্যসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছেছে ঠিকই, কিন্তু নারীদের কাছে তা অধরাই থেকে গেছে।
শাল্লার সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং চীনের ‘নগ্নপদ চিকিৎসক’ মডেলের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্র্যাক একটি টেকসই স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোক্তা মডেল তৈরি করলো। এই মডেলের আওতায় স্থানীয়দের মধ্য থেকে বাছাই করা নারীদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়ে নারী স্বাস্থ্যকর্মীর দল তৈরি করলো তারা। এরপর তারা তখন নিজেদের জনগোষ্ঠীরই নারীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে শুরু করলেন। ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবাকর্মী বাহিনীর দুটি স্তর- একটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অপরটি স্বাস্থ্যসেবিকা।
বর্তমানে এই বাহিনীর ৫০ হাজার স্বাস্থ্যসেবাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশের ৬১ জেলায় বছরে প্রায় আট কোটি মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ব্র্যাকের কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা মডেলটি সারা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। মডেলটি অনুসরণ করে অনেক দেশে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অর্জনের পেছনে ব্র্যাকের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। আমাদের অনেক সফল কার্যক্রমের পেছনের রহস্য লুকিয়ে আছে বাস্তব সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে নেওয়া শিক্ষা এবং কমিউনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে। এর একটি উদাহরণ মুখে খাওয়ার স্যালাইন ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ। গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত ডায়রিয়া ছিল দেশে শিশুমৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর.বি)-তে কর্মরত বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্যাশ ও সতীর্থরা মুখে খাওয়ার স্যালাইন ততদিনে উদ্ভাবন করে ফেলেছেন। কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর হলেও পরীক্ষাগারে সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত সেই সমাধান মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ব্র্যাক তখন এটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে এগিয়ে আসে। এ জন্য ব্র্যাক উদ্ভাবিত দ্রবণটির একটি অত্যন্ত সহজ বিকল্প তৈরি করে, যা কিনা রান্নাঘরে বসেই তৈরি করা সম্ভব। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর দল তখন নিজেদের এলাকার প্রত্যেকটি ঘরে গিয়ে মায়েদের শেখালেন কী করে রান্নাঘরের উপকরণ দিয়ে জীবন রক্ষাকারী সেই দ্রবণ তৈরি করতে হয়। এক চিমটি লবণ, একমুঠো গুড় ও আধা লিটার পানির সেই বিখ্যাত শরবত তৈরির পদ্ধতি এভাবে পৌঁছে গেলো এক কোটি বিশ লাখ ঘরে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করেই দেশের শিশুমৃত্যুর হার ৪৫ শতাংশ হ্রাস পেলো।
২০২০ সালে যখন কোভিড-১৯ অতিমারি ধেয়ে এলো, এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে তা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেরও জানা ছিল না। কিন্তু এই সংকট মোকাবিলায় তাৎক্ষণিকভাবে ব্র্যাকের ৫০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী গ্রাম, দুর্গম এলাকা ও নগরের বস্তিতে ঘরে ঘরে গিয়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জীবন রক্ষাকারী উপায়গুলো সম্পর্কে অবহিত করেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অতিমারির প্রভাব জটিল ও বহুমাত্রিক রূপ নিলো। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তিনটি নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে একগুচ্ছ সুসংহত উদ্যোগ নিতে পেরেছি আমরা।
এক. কোভিড-১৯ প্রতিরোধমূলক আচরণের চর্চা প্রতিষ্ঠা জরুরি;
দুই. তৃণমূলের মানুষকে নতুন আচরণ চর্চায় অভ্যস্ত করতে হলে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক; এবং তিন. স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে ও আমাদের পদক্ষেপগুলো ছড়িয়ে দিতে হলে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
এ পর্যন্ত ব্র্যাক মন্ত্রের সাফল্যের পেছনে স্থানীয় মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনকে কেন্দ্রে রেখে সমাধান তৈরির চর্চা মূল ভূমিকা পালন করেছে। সমস্যার সমাধান খোঁজার প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রে ছিল তাদের সক্রিয় সম্পৃক্তি। সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে সেটা তাদের বলে দেওয়া নয়, বরং নিজেদের সমস্যা নিজেরা যাতে সমাধান করতে পারেন সেই লক্ষ্যে তাদের সামর্থ্য বৃদ্ধি ও সমস্যা সমাধানে যে সম্পদগুলোর প্রয়োজন সেগুলো যাতে ব্যবহার করতে পারেন সেই পথটা খুলে দিতেই কাজ করেছে ব্র্যাক। সেই ধারাবাহিকতায় সামনের দিনগুলোতেও বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির পরিবর্তন ধারাবাহিক থাকবে।
লেখক: পরিচালক, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি, ব্র্যাক।
সহ-লেখক: তানজিলা মজুমদার দৃষ্টি, সিনিয়র ম্যানেজার, অ্যাডভোকেসি, নলেজ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড পার্টনারশিপ ম্যানেজমেন্ট, ব্র্যাক।
Discussion about this post