অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ আমিন, বিভাগীয় প্রধান, হরমোন বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
ইনসুলিন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে ডায়াবেটিসের রোগীরা খুব অল্প বয়সেই মারা যেতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় আবিষ্কৃত হয়, ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিন ঘাটতি থাকে আর সেটির উৎস পরিপাক রস নিঃসরণকারী গ্ল্যান্ড ‘প্যানক্রিয়াস’। প্যানক্রিয়াস নিঃসৃত পদার্থটি নিয়ে গবেষণা চলে বিস্তর, কিন্তু সফলতা আসে না। পরবর্তী সময়ে কার্যকর সমাধান দেন দুই চিকিৎসাবিদ—ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং ও চার্লস বেস্ট। ১৯২১ সালে ইনসুলিন আবিষ্কার করতে তাঁরা পুরোপুরি সক্ষম হন। লিওনার্ড থমসন প্রথম ডায়াবেটিস রোগী, যাকে ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু হয়। এরপর ডায়াবেটিস আর মারাত্মক নয়, নিয়ন্ত্রণযোগ্য রোগ হিসেবে গণ্য হতে থাকে।
গবেষণায় দেখো গেছে, শুধু ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করাটাই মুখ্য নয়। রোগীর রক্তে চিনির মাত্রা সারা দিন নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, সেটা খুবই জরুরি। অর্থাৎ খালি পেটে, দুপুরের খাওয়ার আগে, রাতে খাওয়ার আগে ৬-৭ মিলিমোল/লিটার এবং সকাল ও রাতে খাওয়ার পর ৮-১০ মিলিমোল/লিটার রাখতে হবে। গড় ডায়াবেটিস এইচবিএ১সি ৭ শতাংশের নিচে থাকবে। শুধু তা-ই নয়, যত তাড়াতাড়ি ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা যাবে, তত বেশি প্যানক্রিয়াসকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সঙ্গে বিটা সেলকে ধ্বংস হওয়া থেকেও রক্ষা করা যায়। ইনসুলিনের মাধ্যমে রক্তের শর্করা সহজে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, যেটি ট্যাবলেটের মাধ্যমে কষ্টসাধ্য। একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিনই শেষ চিকিৎসা। সত্যিটা হলো, ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইনসুলিন শেষ চিকিৎসা নয়, বরং শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা।
বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন বাজারে পাওয়া যায়। রাসায়নিক গঠনের ওপর ভিত্তি করে কোনোটিকে স্বল্পমেয়াদি, মাঝারি, আবার কোনোটিকে দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে তৈরি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য সারা দিনের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা। এসব ইনসুলিন রোগীর সঙ্গে আলোচনা করে তার জন্য উপযোগী নির্দিষ্ট মাত্রা—দিনে দুই, তিন ও চারবার, আবার অনেক ক্ষেত্রে দুই ধরনের ইনসুলিনই মিলিয়ে দেওয়া হয়।
স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেহে দুই ধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। অভুক্ত অবস্থায় শরীরের নিজস্ব যে গ্লুকোজ তৈরি হয়, সেই গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা দিন অভুক্ত থাকলেও একধরনের ইনসুলিন নিঃসরিত হবে। এই ইনসুলিনকে বলা হয় বেসাল ইনসুলিন। আবার আমরা যখন খাবার খাই, সেটি যে খাবারই হোক, যে পরিমাণই হোক, শরীরে সেই খাবার গ্লুকোজ হিসেবেই জমা হয়। খাওয়ার পর সে গ্লুকোজ রক্তে আসে, তাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যানক্রিয়াস থেকে আরেকভাবে ইনসুলিন নিঃসরিত হয়। এই ইনসুলিনকে বলা হয় বোলাস ইনসুলিন, যা খাবারের পরের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে।
একজন সুস্থ মানুষের দেহে এই দুই ধরনের ইনসুলিন সঠিক মাত্রায় তৈরি হলেও ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এর ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে তাদের শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই নতুন ধারণাকে মাথায় রেখে ইনসুলিন সরবরাহের ক্ষেত্রে নতুন করে ইনসুলিন মলিকিউল তৈরি করা হচ্ছে। গবেষণার মাধ্যমে এ ধরনের ইনসুলিন এখন পাওয়া যাচ্ছে।
এই ইনসুলিন সারা দিনে একবার গ্রহণ করে ২৪ ঘণ্টায় আমাদের শরীরে অভুক্ত অবস্থায় যে পরিমাণ ইনসুলিনের প্রয়োজন, তার ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তবে এটা দিয়ে খাবারের পর যে শর্করা তৈরি হয়, সেটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে খাওয়ার পর রক্তের বাড়তি শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ইনসুলিন (বোলাস ইনসুলিন) দরকার, তার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যেটা আগের ইনসুলিন দিয়ে সম্ভব ছিল না। এটাই হলো বোলাস ইনসুলিনের কার্যকারিতা। ফলে সঠিকভাবে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এবং রক্তে শর্করার স্বল্পতা, অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিয়া এড়ানো সম্ভব।
এখন আমরা যদি একই সঙ্গে বেসাল ও বোলাস ইনসুলিন ব্যবহার করি, তাহলে অভুক্ত অবস্থায় এবং খাওয়ার পর শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ সুস্থ মানুষের মতো সঠিকভাবে করা সম্ভব। ফলে ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকে খুব সহজেই ভালো থাকা সম্ভব। সমস্যা হচ্ছে বোলাস ও বেসাল ইনসুলিন রোগীদের চারবার নিতে হয়। এতে অনেকে অনীহা প্রকাশ করে। তাই দুবার ইনসুলিন দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।
জেনে রাখা দরকার, অসুস্থ হলেও সময়মতো ইনসুলিন নিতে হবে। হয়তো ডোজ কম লাগবে কারও কারও। কারণ, আমাদের শরীরে যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিছু হরমোন তৈরি হয়, যা রক্তে শর্করা বাড়িয়ে দিতে পারে। ইনসুলিনের অভাবে একদিকে রক্তের শর্করা শরীরের কাজে লাগে না, অপর দিকে তাপ ও শক্তির জন্য দেহের সঞ্চিত চর্বি অতিরিক্ত ভেঙে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেমন কিটন বডি বেশি মাত্রায় রক্তে বেড়ে যায়। ফলে রোগী অজ্ঞান হয়েও যেতে পারে। এ অবস্থাকে ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস বলে।
আসলে ইনসুলিন ডায়াবেটিস রোগীর একটা অধিকার। ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা মেটানো যেমন অধিকার, সে রকম ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজ বেশি থাকলে ইনসুলিন দিয়ে তা কমানো, রোগীর ভালো থাকাও একটা অধিকার।
নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা
যাঁদের পক্ষে সম্ভব, তাঁরা অবশ্যই গ্লুকোমিটার কিনে নেবেন। প্রতিদিন সম্ভব না হলে সপ্তাহে এক দিন অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ নিজের মেশিনে চেক করে নেবেন। রক্তের এ পরীক্ষা দিনের বিভিন্ন সময়ে করতে হবে (খালি পেটে, নাশতার দুই ঘণ্টা পর দুপুরের খাওয়ার আগে ও পরে, রাতে খাওয়ার আগে ও পরে)। খাবার অবশ্যই পরিমিত খাবেন (খাদ্য তালিকা অনুযায়ী) এবং অল্প করে তিন ঘণ্টা পরপর খেতে হবে। সকাল ৮টা, বেলা ১১টা ও ২টা, বিকেল ৫টা, রাত ৯টা এবং রাতে ঘুমানোর আগে অবশ্যই কিছু খেয়ে শোবেন। নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং ওষুধ খাওয়ার পরও যদি একজন রোগীর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকে অথবা এইচবিএ১সি ৭ শতাংশের বেশি থাকে, তবে বুঝতে হবে, শরীরে ইনসুলিন তৈরির ক্ষমতা কমে যাচ্ছে অথবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনে ইনসুলিন শুরু করতে হবে। নতুন অবস্থায় অথবা হঠাৎ রক্তের গ্লুকোজ কোনো কারণে বেড়ে গেলে ইনসুলিন নিয়ে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে হবে। ইনসুলিন নিতে প্রত্যেক রোগীই ভয় পায়। শরীর ভালো রাখতে হলে ইনসুলিন নিয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শরীর ভালো থাকলে, মন ভালো থাকে, কাজকর্মে দক্ষতা বাড়ে।
রোগীরা অনেক সময় ইনসুলিন নিতে চায় না। চিকিৎসক হিসেবে আমাদের তাতে সাড়া না দিয়ে বরং বুঝিয়ে শুরু করা উচিত।
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটবেন। এমনভাবে হাঁটতে হবে, যাতে আপনার হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পায়। হাঁটা শুরুর আগে ৫-১০ মিনিট শরীর গরম করে নেবেন এবং ৩০ মিনিট জোরে হাঁটার পর আবার ধীরে ধীরে হেঁটে শরীর ঠান্ডা করে নেবেন। হাঁটতে যাওয়ার আগে পানি খেয়ে নেবেন।
আর অসুস্থকালীন দিনগুলোতেও ইনসুলিন নেওয়া বন্ধ করা যাবে না। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অধিক মাত্রায় ইনসুলিনেরও দরকার হতে পারে। ইনসুলিনের মাত্রা নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সুখে থাকুন, অসুখে নয়।
Discussion about this post