হার্টবিট ডেস্ক
নাসিরউদ্দিন সাহেব একজন সরকারি চাকরিজীবি, কাজ করেন জনতা ব্যাংকে। ম্যানেজারের চাকরি, তাই সারাদিন চেয়ারে বসে বসেই দায়িত্ব পালন করতে হয় সদ্য পঞ্চাশের কোঠা পেরোনো এই মানুষটিকে। পরিচিতজনদের কাছ থেকে আরাম বাবু খেতাবটা পেয়ে গেছেন অনায়াসে।
কিন্তু কিছুদিন ধরে এই আরাম বাবু মোটেও আরামে নেই। আরামে থাকবেনই বা কীভাবে? কোমর আর কাঁধের ব্যথাটা শরীরটাকে দু’দন্ড শান্তিতে থাকতে দিলে তো!
প্রথম প্রথম ভেবেছিলেন বাতের ব্যথা, বয়স বাড়লে একটু অাধটু ওরকম হয়। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক গোটা গোটা পেইনকিলার খেয়েও যখন কোনো সুফল পাওয়া গেল না, তখন অারাম বাবু পড়িমড়ি করে ছুটলেন চিকিৎসকের দুয়ারে। কতগুলো মেডিকেল টেস্ট আর ভিজিট শেষে চিকিৎসক যখন বললেন, আরাম বাবুর ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়েছে, তখন তার চোখ কপালে ওঠার দশা। আরে, এই ফাইব্রোমায়ালজিয়া জিনিসটা আবার কী?
ফাইব্রোমায়ালজিয়া কী?
ফাইব্রোমায়ালজিয়া শব্দটি অনেকের কাছেই অপরিচিত ঠেকলেও রোগের উপসর্গের সাথে অনেকেই পরিচিত হয়ে থাকবেন। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা, যার প্রধান উপসর্গ হলো মাংসপেশি, টেন্ডন এবং অস্থিসন্ধিগুলোতে প্রদাহ। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপি হাজার হাজার মানুষ এই রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং চিকিৎসার আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
রোগটির উপসর্গগুলো খুবই সাধারণ হওয়ার কারণে প্রায়ই রোগটি নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত এবং পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে সংক্রমণের হার প্রায় সাতগুণ বেশি।
ইতিহাস
ফাইব্রোমায়ালজিয়া কোনো নতুন রোগ নয়। রোগটিকে উনবিংশ শতাব্দীর দিকে মানসিক রোগ বলে অ্যাখ্যায়িত করা হতো। তখন এর নাম ছিলো মাসক্যুলার রিউম্যাটিজম। ১৮২০ সালের দিকে স্কটল্যান্ডের একজন চিকিৎসক রোগটির জন্য দায়ী শরীরের বিভিন্ন সংবেদনশীল অংশের বর্ণনা দেন।
১৯০৪ সালে গাওয়ার সর্বপ্রথম ফাইব্রোসাইটিস শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে শব্দটি ফাইব্রোমায়ালজিয়া শব্দে পরিবর্তিত হয়। শব্দটি ল্যাটিন শব্দাংশ ফাইব্রা (তন্তু), গ্রিক শব্দাংশ মায়োস (পেশি) এবং অ্যালগস (ব্যথা) এর সমন্বয়ে গঠিত। ১৯৮৬ সালে গবেষকরা এই রোগে নরএপিনেফ্রিক/সেরোটোজেনিক ড্রাগস ব্যবহার করে সুফল পান।
কারণ
দ্য ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব অার্থাইট্রিস অ্যান্ড মাস্কুলোস্কেলেটাল অ্যান্ড স্কিন ডিজিজের মতে, প্রধান কারণ হলো ট্রমাটিক ঘটনা, শারীরিক অাঘাত এবং অন্য কোনো রোগ বা অসুস্থতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
বংশগতির প্রভাব: গবেষকদের মতে, কিছু জিনের মিউটেশনের কারণে এই রোগটি হয়ে থাকে। যদিও কোন কোন জিন এজন্য দায়ী, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।
ধারণা করা হয়, এই জিনগুলো শরীরের সেরাটোনিন, ডোপামিন এবং ক্যাটেচোলামিন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সাথে জড়িত। যদি কারো পরিবারের কোনো রক্ত সম্পর্কীয় অাত্মীয়ের অাগে থেকে রোগটি থেকে থাকে, তাহলে তার ফাইব্রোমায়ালজিয়ায় অাক্রান্ত হওয়ার অাশংকা বেড়ে যায়। এজন্য দায়ী জিনগুলো ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম এবং বিষণ্নতা রোগের সাথে সম্পর্কিত থাকায়, তা রোগ নির্ণয়কে অারো জটিল করে তোলে।
ট্রমা: বিভিন্ন ট্রমাটিক ঘটনা, যেমন- শৈশবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ফাইব্রোমায়ালজিয়ার লক্ষণগুলোকে অারো প্রকট করে তোলে। এছাড়াও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারের সঙ্গে রোগটির সম্পর্ক রয়েছে।
মানসিক উদ্বেগ: মানসিক উদ্বেগ শুধু মন নয়, শরীরেও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও উদ্বেগে ভুগলে শরীর থেকে হরমোনের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ ঘটে, যা ফাইব্রোমায়ালজিয়ার লক্ষণ প্রকাশে সহায়তা করে।
মনস্তাত্ত্বিক কারণ: বিষণ্নতাকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করা যায়। এছাড়াও বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর কো-মরবিডি হিসেবে ফাইব্রোমায়ালজিয়া দেখা দিতে পারে।
উপসর্গ
ফাইব্রোমায়ালজিয়ার উপসর্গগুলো শরীরের নমনীয় অংশগুলোতে বেশি পরিলক্ষিত হয়, যাকে ট্রিগার পয়েন্ট বলা হয়। কেননা, এসব অংশ এতটাই সংবেদনশীল যে, সামান্য চাপ বা আঘাতেই প্রচন্ড যন্ত্রণার উদ্রেক ঘটে। সাধারণ কিছু কিছু উপসর্গ তিন মাসের বেশি স্থায়ী হলে ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এগুলো হলো-
- মাইগ্রেনের উপসর্গের সাথে মাথার পেছন দিকে যন্ত্রণা।
- যেসকল স্থানে অস্থিসন্ধি বিদ্যমান, যেমন দুই কাঁধের উপরিভাগ, কোমর, কনুই এবং হাঁটুতে ব্যথা অনুভব করা। এ ব্যথা মাসের পর মাস স্থায়ী হতে পারে।
- দৈনন্দিন কাজ করতে গিয়ে সহজেই ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত অনুভব করা, যা বিশ্রাম নিলেও দূর হতে চায় না।
- অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালনায় অসাড়ভাব এবং মাংসপেশিতে জমাটবদ্ধতা এবং খিঁচুনি অনুভব করা।
- অনিদ্রা কিংবা স্লিপ ডিজঅর্ডারে ভোগা।
- কোনো তথ্য মনে রাখতে বা প্রক্রিয়াজাত করতে অসুবিধা হওয়া।
- কথা বলতে অসুবিধা হওয়া।
- বিপাকে এবং রেচনে সমস্যা দেখা দেয়া।
রোগনির্ণয়
যেমনটি অাগেই বলা হয়েছে, এ রোগটি নির্ণয়ের কোনো সুনির্ধারিত পরীক্ষা নেই। তবে আমেরিকান কলেজ অব হেমাটোলজি ওয়াইডস্প্রেড পেইন ইনডেক্স (WPI) এবং সিম্পটম সিভিয়ারিটি স্কেল (SSC) এর অালোকে দুটি বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, যার সাহায্যে কারো ফাইব্রোমায়ালজিয়া হয়েছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়।
১. উপসর্গগুলোর তিন মাস বা তার চেয়েও অধিক স্থায়ীত্ব।
২. অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতার অনুপস্থিতি।
চিকিৎসা
ফাইব্রোমায়ালজিয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি নেই। তবে উপসর্গগুলোর ওপর ভিত্তি করে দু’রকম প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে নিরাময় চালানো হয়।
১. ওষুধ: সাধারণত ডিজঅর্ডারগুলোর সাথে লড়াই করার জন্য অ্যানালজেসিক্স এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামাটরি জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। সেই সাথে ব্যথা উপশমের জন্য অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস বা বিষণ্নতা বিরোধী ওষুধ সেবন করতে হয়। মূলত এগুলোর লক্ষ্য হলো, যন্ত্রণার মাত্রা কমিয়ে এনে রোগীকে ঘুমাতে সহায়তা করা।
২. সাইকোথেরাপি: বিভিন্ন সাইকোথেরাপি, যেমন- সিবিটি (কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি) ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যেতে পারে।
করণীয়
নিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস অনুশীলন: প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ লবণ, স্নেহ সমৃদ্ধ খাবার যাতে থাকে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কেননা এতে দেহের মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য অক্ষুণ্ন থাকে। এটি নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সেই সাথে অধিক চিনি এবং কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার, যেমন- ফাস্ট ফুড এবং কোমল পানীয় যথাসম্ভব পরিহার করে চলতে হবে। কেননা এগুলো বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পেশিতে ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে।
বেশি বেশি আমিষ গ্রহণ: পরিমিত পরিমাণে অামিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। প্রাণীজ অামিষের ক্ষেত্রে মাংসের তুলনায় মাছকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ, যেমন- স্যামন, টুনা, ট্রট, ম্যাকরেল অামাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ওমেগা-৩ অ্যাসিডের অভাব পূরণ করে। তাই এগুলোকে নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
খেতে হবে শাকসবজিও: বিভিন্ন ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ শাক সবজি, যেমন পালং শাক, লেটুস পাতা, অ্যাস্পারাগাস এটি নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও পেঁয়াজ, রসুন, বাঁধাকপি, শসা, কমলালেবু এবং অাপেলে রয়েছে সেলেনিয়াম, যা এর নিরাময়ে একটি অত্যাবশকীয় উপাদান বলে মনে করা হয়।
ঘন ঘন পানি পান: ফাইব্রোমায়ালজিয়া নিরাময়ে ব্যবহৃত ওষুধগুলোর অন্যতম প্রধান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো ঘন ঘন গলা শুকিয়ে অাসা। এ পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য দৈনিক কমপক্ষে অাট গ্লাস পানি পান করা অাবশ্যক। সেই সাথে অ্যান্টি-ডাইইউরেটিকস (চা-কফি) এবং অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় পরিহার করা উচিত, কেননা এগুলো রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
লবণ থেকে সাবধান: দৈনন্দিন খাদ্যে লবণের পরিমাণ যতটা কম রাখা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্য পরিহার করে চলা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এসব খাদ্য মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সোডিয়াম সমৃদ্ধ হয়ে থাকে।
নিয়মিত শারীরিক কসরত: যাদের ফাইব্রোমায়ালজিয়া রয়েছে, তারা সবসময় ক্লান্তি, শ্রান্তি এবং দৈহিক দুর্বলতা অনুভব করেন। এটি কমিয়ে অানতে নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম এবং কসরত একটি কার্যকরী পন্থা। বিভিন্ন কার্ডিওভাস্কুলার ব্যায়ামের চর্চায় একজন ফাইব্রোমায়ালজিয়া রোগী দীর্ঘমেয়াদী সুফল পেতে পারেন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ানো এসব ব্যায়ামের মধ্যে অন্যতম।
Discussion about this post