হার্টবিটডেস্ক
গাবতলী থেকে সদরঘাটগামী ‘বেড়িবাঁধ’ সড়ক। মাঝারি গতিতে একটি প্রাইভেটকার ছুটে গেল। একরাশ ধুলাবালি উড়ে এসে আশপাশের মানুষকে ‘নাস্তানাবুদ’ করে দিল। তাদের একজন সেলিম হোসেন। পাঁচ বছর ধরে রাজধানীর এই এলাকায় একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করছেন। সেলিম হোসেন বললেন, ‘দুই মুট (দুই মুঠো) ভাতের লাইগা এইখানে কাজে আইছিলাম। ভাত তো খাইতেছি, তয় আমারেও খাইতেছে ধুলাবালি।’
ঢাকা পোস্টকে জানান, পাঁচ বছর আগে তিনি যখন বেড়িবাঁধ আসেন তখন দিব্যি সুস্থ ছিলেন। কিন্তু দিনে দিনে ঠান্ডা-কাশি শুরু হয়। চিকিৎসক জানিয়েছেন, প্রচণ্ড ধুলাবালির কারণে তার এই দুর্ভোগ। সেলিম এখন বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার কথা ভাবছেন। কিন্তু ধুলার দৌরাত্ম্যে ধূসর হয়ে যাওয়া পুরো রাজধানীর বাসিন্দাদের কপালে কী আছে?
টানা চারদিন বিশ্বে বায়ুদূষণের তালিকায় শীর্ষে থাকা ঢাকার বাসিন্দাদের মনে এখন এমন প্রশ্নই ঘুরছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান যাচাই বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউ এয়ার’ বলছে, ১৯ থেকে ২২ জানুয়ারি ঢাকায় বায়ুর মান সূচক ছিল গড়ে যথাক্রমে ২২৬, ২৩৩, ২৪৩ ও ২৫৮। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’।
২১ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুর মান সূচক ছিল ৩৭২। ওই সময় বায়ুতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৩২২ মাইক্রোগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে যা ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’
এদিকে, ২১ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় বায়ুর মান সূচক ছিল ৩৭২। ওই সময় বায়ুতে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৩২২ মাইক্রোগ্রাম। বিশেষজ্ঞদের মতে যা ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুর মান সূচক শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত ‘ভালো’ বা স্বাস্থ্যবান্ধব বলে গণ্য হয়। এর বেশি হলেই শুরু হয় ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’। সেই হিসেবে ঢাকাবাসী ভয়াবহ ‘রেড এলার্ট’-এর মধ্যে আছেন।
বায়ুদূষণ যদি এভাবে চলতে থাকে তবে শ্বাসতন্ত্রের রোগ অনেক বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ক্যান্সারের মতো রোগীর সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে, উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দূষণের শুরুটা বায়ু থেকে হলেও শেষ হচ্ছে জনজীবন ও প্রকৃতি বিনষ্টের মধ্য দিয়ে। যা পুরো পৃথিবীর জন্যই মারাত্মক হুমকি।ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় মাটি থেকে দুই হাজার টন ধুলাবালি আকাশে ওড়ে। এর সবই উড়ে চলে যায় না, কোথাও কোথাও এগুলো থেকে যায়। কুয়াশার সঙ্গে মিশে ধুলাবালি ভারী হয়ে নিচে নেমে আসে। এজন্যই আমরা ভর দুপুরেও ধোঁয়াশা দেখিড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার, বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ
সম্প্রতি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় মাটি থেকে দুই হাজার টন ধুলাবালি আকাশে উড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
রাজধানীর বায়ুমান হঠাৎ এমন খারাপ কেন হলো- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক দিন বৃষ্টি নেই। বাতাস শুষ্ক। এ কারণে ধূলিকণা সহজে উড়তে পারছে। এছাড়া বায়ুদূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। এসব কারণে দূষণের পরিমাণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় মাটি থেকে দুই হাজার টন ধুলাবালি আকাশে ওড়ে। এর সবই উড়ে চলে যায় না, কোথাও কোথাও এগুলো থেকে যায়। কুয়াশার সঙ্গে মিশে ধুলাবালি ভারী হয়ে নিচে নেমে আসে। এজন্যই আমরা ভর দুপুরেও ধোঁয়াশা দেখি।’
বায়ুদূষণের কারণ ও বিরূপ প্রভাব
বায়ুদূষণ বাড়ার পেছনে দুটি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি হচ্ছে ‘উৎস’, আরেকটি হচ্ছে ‘কারণ’। ‘কারণগুলোর’ মধ্যে রয়েছে— প্রাকৃতিক কিছু বিষয় (আবহাওয়া ও জলবায়ু), নগর পরিকল্পনার ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা, আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব।
অন্যদিকে ‘উৎসগুলোর’ মধ্যে রয়েছে— সমন্বয়হীনভাবে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ব্ল্যাক কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, ইটের ভাটা ও শিল্প কারখানা, উন্মুক্তভাবে আবর্জনা পোড়ানো, বস্তি এলাকার বর্জ্য পুড়ানো এবং আন্তর্দেশীয় বায়ু দূষণ।
বর্তমান বায়ুদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর— এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বায়ুমান পৃথিবীর দূষিত জায়গার মধ্যে অন্যতম। এটা নিয়ে জাতীয়ভাবে তো বটেই, আন্তর্জাতিক সমাজের পক্ষ থেকেও নানাভাবে সতর্ক করা হয়েছে। বায়ুদূষণ হলে মানুষসহ সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণী অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানুষের মধ্যে শ্বাস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ বেড়ে যায়। যেমন- ঠান্ডা, হাঁচি, কাশি ইত্যাদি। যাদের অ্যাজমা বা অ্যালার্জি আছে, সেগুলোও বেড়ে যায়। নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা বেড়ে যায়। দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে মানুষের ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।’বাতাসের মধ্যে যে মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ থাকে তা বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে আমাদের রক্তনালীর মধ্য দিয়ে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। ফলে আমাদের লিভার ও কিডনির মতো অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। শুধু বিকলই নয়, একসময় এর কার্যক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়ডা. লেলিন চৌধুরী, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
তিনি আরও বলেন, “বাতাসের মধ্যে যে মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা ‘পিএম ২.৫’ থাকে তা বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে আমাদের রক্তনালীর মধ্য দিয়ে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। ফলে আমাদের লিভার ও কিডনির মতো অঙ্গগুলো ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পড়ে। শুধু বিকলই না, একসময় এর কার্যক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়।”
মানুষের শরীরে দূষিত বাতাসের প্রভাবে যে বিষক্রিয়া হয়, তাতে গর্ভবতী নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ে যায় এবং গর্ভস্থ শিশুর বিকলাঙ্গতাও বেড়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে সার্বিকভাবে আমাদের মতো দেশের মানুষের গড় আয়ু সাত বছরের মতো কমে যায়। এ কারণে আমাদের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, জাতীয়ভাবে নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি শ্রমঘণ্টাও— বলেন ডা. লেলিন চৌধুরী।
এমন অবস্থায় জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বায়ুদূষণ রোধে সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তর কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে—জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্ট বায়ুদূষণ রোধে আমাদের মন্ত্রণালয়কে একটা নির্দেশিকা তৈরির জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে বায়ুদূষণ রোধে একটা নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে নির্দেশিকা হাতে পাওয়ার পর এটি আমরা বিভিন্ন জায়গায় পাঠিয়ে দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রাজউক, গণপূর্ত অধিদপ্তর, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস প্রকল্প পরিচালক, তিতাস গ্যাস, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট, রিহ্যাবসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এই নির্দেশনা আমরা ২০২১ সালের নভেম্বরে পাঠিয়েছি। একই সঙ্গে ডিএমপি কমিশনারকেও এই চিঠি দেওয়া হয়েছে, যেন রাজধানীর ভেতর মালামাল ঢেকে ট্রাক চলাচল করে। একই সঙ্গে পরিবেশ দূষণ রোধে সবাইকে জানাতে দেশের প্রথম সারির মিডিয়াগুলোতেও গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি।
’আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের যে কাজটা ছিল, সেটা আমরা করেছি। এটা সত্য যে, আমাদের নির্দেশনাগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পূরণ হয়নি। যদি তা হতো, তাহলে আজ ভালো রিপোর্ট আসত। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার, কোনো কিছুই বাদ দিইনি। আমরা সবাইকে অনুরোধ করেছি, কিন্তু অন্যদেরও দায়িত্ব আছে নির্দেশনাগুলো মানার’ মো. আশরাফ উদ্দিন, মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
আশরাফ উদ্দিন আরও বলেন, ‘আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের যে কাজটা ছিল, সেটা আমরা করেছি। এটা সত্য যে, আমাদের নির্দেশনাগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পূরণ হয়নি। যদি তা হতো, তাহলে আজ ভালো রিপোর্ট আসত। আমাদের পক্ষ থেকে যা যা করার, কোনো কিছুই বাদ দিইনি। আমরা সবাইকে অনুরোধ করেছি। কিন্তু অন্যদেরও দায়িত্ব আছে নির্দেশনাগুলো মানার।সৌজন্যে-ঢাকাপোষ্ট
Discussion about this post