অধ্যাপক ডা. এ এস কে আব্দুর রাজ্জাক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগর
অনেক কারণে হার্টের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হতে পারে, যা কার্ডিওমেগালি নামে পরিচিত। এটি রোগ, যা অনেক কারণে হতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
কার্ডিওমেগালি বা হার্ট বড় হয়ে যাওয়া মোটেই কাজের কথা নয়। এতে বহু ধরনের শারীরিক অসুখবিসুখ হতে পারে। সাধারণত অন্য কিছু অসুখের কারণে, যেমন উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্টের আকার বড় হয়ে যায়। তখন আর হার্ট আগের মতো কাজ করতে পারে না। হার্টের প্রধান কাজ রক্ত পুরো শরীরে পাম্প করা, যা তখন আর ঠিকমতো করতে পারে না।
হার্টের আকার সাময়িকভাবেও বড় হতে পারে। যেমন গর্ভকালীন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অসুখজনিত কার্ডিওমেগালি হয়, যা আর আবার ঠিক হয় না। কিন্তু রোগটি যদি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা যায়, তবে বহু ক্ষেত্রে আকার আবার স্বাভাবিক হতে পারে।
কার্ডিওমেগালি হয়েছে কি না তা সাধারণত বুকে ব্যথা, দ্রুত হাঁপিয়ে ওঠা, হাত-পায়ে পানি আসা ইত্যাদি লক্ষণ দিয়ে বিবেচনা করা হয়।
কেন হয়?
যে অসুখগুলোতে হার্টকে রক্ত পাম্প করতে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয় করতে হয় সেগুলোর পরিণতি হিসেবে হার্টের আকার সাধারণত বড় হয়। তবে কোনো কারণ ছাড়াও এটি হতে পারে, যা ইডিওপ্যাথিক হিসেবে পরিচিত।
আবার জন্মগত বা কনজেনিটাল, হার্টঅ্যাটাকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর কিংবা অনিয়মিত হৃত্স্পন্দনের ইতিহাস থাকলেও হার্ট বড় হয়ে যেতে পারে। যেসব অসুখে সাধারণত কার্ডিওমেগালি হতে পারে—
উচ্চ রক্তচাপ : এ অসুখে রক্তনালির ভেতর সরু হয়ে যায় বলে রক্তকে পুরো শরীরে পাম্প করতে হার্টকে বাড়তি শক্তি ব্যয় করতে হয়। এভাবে দীর্ঘদিন উচ্চ রক্তচাপে ভুগলে হার্টের মাংসপেশি বড় ও মোটা হয়ে কার্ডিওমেগালি হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপে সাধারণত হার্টের বাম নিলয় বড় হয়। পরবর্তী সময়ে অলিন্দগুলোও বড় হতে পারে।
হার্ট ভাল্বের অসুখ : রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর, ইনফেকশাস অ্যান্ডোকার্ডাইটিস, কানেকটিভ টিসুৗ ডিসঅর্ডার, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহূত রেডিওথেরাপি ইত্যাদিতে হার্টের ভেতরে থাকা ভাল্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তখনো কার্ডিওমেগালি হতে পারে।
কার্ডিওমায়োপ্যাথি : এটি আসলে হার্টের মাংসপেশির অসুখ। এতে মাংসপেশিগুলো ক্রমেই মোটা ও শক্ত হয়ে আসে। হার্ট রক্ত পাম্প করতে অসুবিধায় পড়ে।
পালমোনারি হাইপারটেনশন : হার্ট থেকে রক্ত পরিশোধিত হওয়ার জন্য ফুসফুসে যায়। কিন্তু পালমোনারি হাইপারটেনশনে রক্ত সহজে ফুসফুসে যেতে পারে না।
পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন : হার্টের চারপাশে পেরিকার্ডিয়াম নামে যে আবরণ থাকে, তাতে পানির মতো তরল জমেও হার্টের আকার বড় হতে পারে।
অ্যানিমিয়া : রক্তাল্পতায় রক্তে অক্সিজেন পরিবহন করার জন্য যথেষ্ট লোহিত কণিকা থাকে না। যদি দীর্ঘদিন অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা না করা হয়, তবে অনিয়মিত হৃত্স্পন্দন হতে পারে, যা কার্ডিওমেগালির কারণ।
থাইরয়েড অসুখ : হাইপারথাইরয়ডিজম কিংবা হাইপো—উভয় কারণেই কার্ডিওমেগালি হতে পারে।
হিমোক্রোমাটোসিস : দেহে অতিরিক্ত লৌহের উপস্থিতিতে এ রোগ হয়। এ রোগে লৌহ বা আয়রন বিভিন্ন অঙ্গে জমা হতে থাকে, এমনকি হার্টেও। এতে হার্টের বাম নিলয় আকারে বড় হয়ে যায়।
অ্যামাইলয়ডোসিস : এ রোগে অস্বাভাবিক প্রোটিন হার্টে জমা হয়ে কার্ডিওমেগালি করতে পারে।
যাদের ঝুঁকি বেশি
• রক্তচাপ যদি ১৪০/৯০ বা এর থেকে বেশি থাকে
• পরিবারের নিকটাত্মীয়ের, যেমন ভাইবোন, যদি কার্ডিওমেগালির ইতিহাস থাকে
• করোনারি আর্টারি ডিজিজ
• জন্মগতভাবে ক্ষতিগস্ত হার্ট
• হার্ট ভাল্বের অসুখ
• হার্টঅ্যাটাকের ইতিহাস
• মাড়ির প্রদাহ বা জিনজিভাইটিসে আক্রান্ত রোগীর যদি হার্ট ভাল্বের ত্রুটি থাকে।
• ডায়রিয়া ও বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত অল্প বয়সী শিশু-কিশোর।
লক্ষণ
সব সময় যে কার্ডিওমেগালি হলে লক্ষণ থাকবে তা নয়। সাধারণত যখন দীর্ঘদিন ধরে কার্ডিওমেগালি হয় তখন লক্ষণগুলো বেশি প্রকাশ পায়। এ ধরনের লক্ষণের মধ্যে আছে—
• বুকব্যথা
• বুক ধড়ফড় করা
• ক্ষুধামান্দ্য বা খাবারে অরুচি হওয়া
• রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে ওঠা
• হাত, পা এবং মুখ ফুলে যাওয়া
• হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া
জটিলতা
হার্ট বড় হয়ে যাওয়া প্রবাদে যত ভালোই শোনাক, বাস্তবে বিপদের কারণই। কার্ডিওমেগালি হলে বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে আছে—
হার্ট ফেইলিওর : কার্ডিওমেগালির অন্যতম জটিলতা এটি। সাধারণত হার্টের বাম অলিন্দ বড় হয়ে এটা হতে পারে। যথাসময়ে চিকিৎসা না করলে আরো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রক্ত জমাট বাঁধা : হার্টের অভ্যন্তরে রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালি ব্লক করে দিতে পারে। জমাট রক্ত যখন রক্তনালি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে যায় তখন সেখানে ব্লক হতে পারে। এ জমাট রক্তের কারণ স্ট্রোক ও হার্টঅ্যাটাকও হতে পারে। কখনো কখনো জমাট রক্ত ফুসফুসে গিয়ে পালমোনারি অ্যামবোলিজমের মতো বিপজ্জনক অসুখেরও কারণ ঘটাতে পারে।
হার্ট মারমার : হার্টের অভ্যন্তরে ভাল্ব বা কপাটিকা যথাযথভাবে বন্ধ হতে পারে না বলে এক ধরনের শব্দ হয়, যা হার্ট মারমার নামে পরিচিত।
হঠাৎ মৃত্যু ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট : কার্ডিওমেগালির কারণে কখনো কখনো হঠাৎ করেই হার্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ মৃত্যুর কারণ ঘটে। এ পরিস্থিতিতে রোগী সাধারণত অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
পরীক্ষা
এ রোগের আধুনিক পরীক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ বহু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আছে। এ ধরনের পরীক্ষার মধ্যে আছে—
বুকের এক্স-রে : সাধারণত বুকের একটি এক্স-রে দেখেই প্রাথমিকভাবে রোগটি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। কারণ এক্স-রেতে হার্টের একটি আকৃতি পাওয়া যায়।
অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে রোগটির কারণ বের করা হয়।
ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম : হার্টের ইলেকট্রিক্যাল কার্যাবলি পরীক্ষার জন্য ব্যবহূত হয়। অনিয়মিত হৃত্স্পন্দন ও হার্টঅ্যাটাকের ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
ইকোকার্ডিওগ্রাম : হার্টের একটি ভিডিও ইমেজ তৈরি করা হয় এবং হার্টের চারটি প্রকোষ্ঠের অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা হয় হার্ট রক্ত ঠিকমতো পাম্প করতে পারছে কি না।
স্ট্রেস টেস্ট : কিছু সময় ব্যায়াম করতে হয় এই টেস্টে। দেখা হয় শারীরিক কার্যক্রম পরিচালনার সময় হার্ট কতখানি কর্মক্ষম আছে।
সিটি স্ক্যান ও এমআরআই : কার্ডিয়াক সিটি স্ক্যান ও কার্ডিয়াক এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে হার্টের সার্বিক কার্যক্রম দেখা যায়।
রক্তের পরীক্ষা : মূলত হার্টের অবস্থা দেখতে নয়, রক্ত পরীক্ষা করতে হয় শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যাবলি সম্পর্কে ধারণা পেতে।
কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন ও বায়োপসি : বিশেষ ক্যাথেটারের মাধ্যমে হার্ট থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয় এবং হার্ট কতখানি পাম্প করতে পারছে তা দেখা যায়।
চিকিৎসা
পুরোপুরি সুস্থতা ফিরে পাওয়া কঠিন। কিছু ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। এ ওষুধগুলোর মধ্যে আছে ডাই-ইউরেটিক, এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম ইনহেবিটর, এনজিওটেনসিন রিসিপ্টর ব্লকার, বিটা ব্লকার, ডিজক্সিন, অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্ট, অ্যান্টি অ্যারিথমিক ইত্যাদি।
সার্জিক্যাল পদ্ধতিতেও কিছু চিকিৎসা করতে হয়। হৃত্স্পন্দন কম থাকলে বা হার্টের পাম্প করার ক্ষমতা কমে গেলে কখনো কখনো পেসমেকার বসাতে হয়। আইসিডি নামের ছোট একটি ডিভাইসও বসানো লাগতে পারে। হার্ট ভাল্বের সার্জারিও অনেক সময় লাগে। করোনারি রক্তনালির অসুখ হলে বাইপাস সার্জারির প্রয়োজন হয় অনেক সময়।
ভালো থাকুন
কিছু নিয়মকানুন মানলে কার্ডিওমেগালিসহ হার্টের অসুখ থেকে ভালো থাকা যায়।
• ধূমপান না করা
• অতিরিক্ত ওজন কমানো
• পাতে অতিরিক্ত লবণ না খাওয়া
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা
• রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা
• নিয়মিত ব্যায়াম করা
• অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন পরিহার করা
• অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানো
• মাড়ির অসুখের যথাসময়ে চিকিৎসা
• রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করতে আয়রনসমৃদ্ধ খাবার বেশি গ্রহণ
• নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে না করা
• বাতজ্বর থাকলে তার চিকিৎসা।
Discussion about this post