অধ্যাপক ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ
১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ছিল। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর এ দিবস পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নবেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং জন্ম নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন। ডায়াবেটিস হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে গ্লুকোজ ব্যবহার কমে যাওয়ার জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। যার ফলে প্রস্রাবের সঙ্গে গ্লুকোজ বের হয়। ঘন ঘন পানির পিপাসা হয়, বেশি বেশি প্রস্রাব হয় ও শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। অসংক্রামক রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে মানুষের হার্ট এ্যাটাক, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ, গর্ভকালীন জটিলতা ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় শরীরের নিম্নঙ্গ কেটেও ফেলতে হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিসের জটিলতায় অনেক মানুষ প্রতি বছর অকাল মৃত্যুতে নিপতিত হচ্ছেন। এসব ছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে চোখের ওপর অনেক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে।
ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি চোখের অন্যতম প্রধান সমস্যা। চোখের দৃষ্টিশক্তির ওপরও ডায়াবেটিসের প্রভাব আছে। চোখের লেন্সে পুষ্টিহীনতা ও রাসায়নিক পরিবর্তনের কারণে লেন্সের আকার বৃদ্ধি পায়। প্রতিসরাংক বা রিফ্রাকটিভ ইনডেক্স পরিবর্তনের ফলে হ্রস্ব দৃষ্টি বা মাইয়োপিয়া হয় এবং কাছে দেখতে অসুবিধা হয়।
ডায়াবেটিসজনিত ছানি- এটা ২ ধরনের হয়। (১) বয়স্ক এবং ডায়াবেটিস রোগীদের ছানি তাড়াতাড়ি হয়। (২) জুভেনাইল ডায়াবেটিস রোগীদের ছানি অল্প বয়সেই হয়।
কনজাংটিভার পরিবর্তন- শিরাগুলো প্রসারিত হয় এবং শিরার শেষ ভাগের ক্যাপিলারীগুলো লম্বা হয়। ধমনী শিরার আনুপাতিক হার ১:৭ হয়।
আইরিশের পরিবর্তন-এখানে পানি জমে ও আইরিশ ফুলে যায় এবং পিগমেন্ট এপিথেলিয়াম নষ্ট হয়। আইরিসের প্রদাহ হয়, নতুন রক্তনালী তৈরি হয় এবং চোখের ভিতর রক্ত জমে ও নিওভাসকুলার গ্লুকোমা হয়।
ভিট্রিয়াস ও রেটিনাতে রক্তক্ষরণ হয় ও নতুন রক্তনালী তৈরি হয়।
স্নায়ু বৈকল্য, ট্যারা চোখ ও দৃষ্টিশক্তির ক্ষতি হয়।
ডায়াবেটিক রোগীদের গ্লুকোমা থাকতে পারে।
এক বস্তুকে দুটি দেখে।
ডায়াবেটিস রোগীদের অনেকেরই ধারণা যে, তাদের চোখের চিকিৎসা শুধু ডায়াবেটিস হাসপাতালেই সম্ভব। এই ভেবে তারা সবাই ডায়াবেটিস হাসপাতালে ভিড় জমায় এবং নানা বিড়ম্বনার শিকার হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল সরকারী-বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডায়াবেটিস
রোগীদের ছানিসহ সকল রোগের চিকিৎসা সফলভাবে নির্বিঘেœ করা হয়। উল্লিখিত হাসপাতালগুলোতে ডায়াবেটিসসহ চোখের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন এবং অন্য সকল বিষয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও রয়েছেন, যারা ডায়াবেটিস রোগীদের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা করে থাকেন।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, শাকসব্জি ও ফলমূল বেশি খাওয়া, নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করা, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত মাপা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করা। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা, চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ পরিবর্তন বা সেবন বন্ধ না করা। এটি শর্করা জাতীয় খাদ্যের বিপাক প্রক্রিয়াজাত জটিলতাজনিত রোগ। ইনসুলিন একটি অগ্নাশয় নিঃসৃত হরমোন। এর অভাবজনিত কারণে ডায়াবেটিস রোগ হয় এবং অনেক সময় ইনসুলিনের প্রতিদ্বন্দ্বী এৎড়ঃিয ঐড়ৎসড়হব বেশি থাকলেও ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ রোগী টাইপ ২ প্রকারের। কিডনিতে নেফ্রপ্যাথি ও চোখে রেটিনোপ্যাথি হয়।
বহুমূত্র রোগে চোখের যে সমস্ত জটিলতা দেখা দেয় তা নিম্নরূপ-
১। ডায়াবেটিসজনিত রেটিনার রোগ (ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি)।
২। রেটিনাতে রক্ত জমাট বাঁধে ও সাদা সাদা প্রদাহজনিত নিঃসরণ দেখা যায়।
৩। ঘন ঘন চশমা পরিবর্তন করা।
৪। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে দৃষ্টি কমে যায় (ইনডেক্স মাওপিয়া)।
৫। কাছে পড়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুর্বলতা।
৬। অল্প বয়সের রোগীদের ডায়াবেটিসজনিত চোখের ছানি হয়।
৭। চোখ লাল হয় এবং রক্তনালীগুলো প্রসারিত হয়।
৮। রেটিনার ম্যাকুলাতে পানি জমে।
৯। আইরিসে প্রহাদ হয়, নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। মনিতে সাদা সাদা ডিমের মতো জমে, রক্তক্ষরণের জন্য চোখে রক্ত জমে ও দৃষ্টি কমে যায়।
১০। রেটিনা ও ভিট্রিয়াস এ রক্ত জমে।
১১। সারা শরীরের সকল স্নায়ুতে দুর্বলতা দেখা দেয়। বিশেষ করে চোখের স্নায়ুগুলোতে।
১২। চোখের পাতা, কর্নিয়া ও আইরিসে প্রদাহ হয়।
১৩। রেটিনার প্রধান ধমনী বন্ধ হয়ে যায় এবং ডায়াবেটিস রোগীদের চোখের উচ্চচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
১৪। ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথির কারণে বহু রোগী অন্ধত্ববরণ করে।
সুতরাং ডায়াবেটিসের কারণে চোখের জটিল রোগ ও অন্যান্য অঙ্গের ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে সকল রোগীকে সতর্ক হতে হবে এবং নিয়মিত চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post