পুষ্টিবিদ হাসিনা আক্তার লিপি
বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সব দেশেরই ডায়াবেটিস একটি বড় সমস্যা। বর্তমানে কম বেশি ৮০ লক্ষ লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনসাথী হয়েই থাকবে। সেই কারণেই খুব ভালো করে এই রোগ সম্বন্ধে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং মানতে হবে। রোগী যদি নিজে সঠিক নিয়ম কানুন জানে, বুঝে এবং মানে তবেই এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ জীবন-যাপন এবং কাজকর্ম করা সম্ভব। আজ আর কারণ, লক্ষণ নিয়ে কিছু বলছি না। কারণ এখন কারণ লাগে না, বয়সও কোন বিষয় নয়। অনেক আগে বলা হতো পরিশ্রম বেশি করলে ডায়াবেটিস হবে না। কিন্তু বর্তমানে কী দেখা যাচ্ছে? কৃষক, রিকশাচালক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক, মন্ত্রী, খেলোয়াড়, কোন্ পেশার লোকের ডায়াবেটিস নাই? আসলে যে কোন বয়সে এবং পেশায় ডায়াবেটিস হচ্ছে। এখন জানা প্রয়োজন ডায়াবেটিস নিয়ে কী করে সুস্থ থাকা যাবে ভালো থাকা যাবে সেই নিয়ম কানুনগুলো।
চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা বা নিয়মগুলো হচ্ছে-
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ৫টি নিয়ম মানতে হয়। তিনটা D এবং দুইটা E
প্রথম D হচ্ছে Diet বা খাদ্য ব্যবস্থা
দ্বিতীয় D হচ্ছে Drug বা ঔষধ
তৃতীয় D হচ্ছে Discipline বা শৃংখলা
চতুর্থ E হচ্ছে Education বা শিক্ষা
পঞ্চম E হচ্ছে Exercise বা ব্যায়াম
আমি যেহেতু পুষ্টিবিদ আমি Diet বা খাদ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েই আজ বলছি- অনেক ডায়াবেটিক রোগী মনে করেন, এই রোগ হলে সব ভালো ভালো মজাদার খাবার খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক কম খেতে হবে। পরিশ্রমের কাজ করা যাবে না ইত্যাদি নানান রকমের ভ্রান্ত ধারণায় থাকেন।
ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্য ব্যবস্থাপনা :
এই রোগে চিকিৎসা পদ্ধতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং দেহের অন্যান্য জটিলতা কমানো।
যে কোনো প্রকার ডায়াবেটিসে খাদ্য অবশ্যই পুষ্টি সম্পন্ন হওয়া উচিত।
খাদ্যের ৬টি উপাদান থেকেই প্রতিবেলার খাবার নির্বাচন করতে হবে। যেমন :
১. শর্করা : ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, খৈ, বিস্কুট, পাউরুটি, ওটস, নুডলস, আলু, কলা।
২. প্রোটিন : মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, বীচি জাতীয় খাবার, মাশরুম, গম, বাদাম, শুটকী মাছ
৩. চর্বি বা ফ্যাট : তেল, ঘি, মাখন, বাাঁর, পনির।
৪. ভিটামিন : সব ধরনের রঙিন শাকসব্জি, কাঁচা ও খোসাসহ ফল-মূল, বিশেষ করে মৌসুমী ফল। ভিটামিন এ, বি, সি, ডি, ই এবং কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫. খনিজ লবণ : সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রণ, আয়োডিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক এবং কপার ইত্যাদি খনিজ উপাদান অল্প পরিমাণে লাগে কিন্তু এদের অভাব হলে অপুষ্টিজনিত নানাবিধ সমস্যা হতে পারে।
৬. পানি : দেহের ওজনের ৬০-৭০% হচ্ছে পানি। প্রতিদিন ৮-১২ গ্লাস পানি অথবা ৩ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান আবশ্যক।
ডায়াবেটিস রোগীর ১ দিনের খাদ্য তালিকা (প্রাপ্ত বয়স্ক)
৩০ গ্রাম = ১/২ ছটাক
ক্যালরী : ২০০০
শর্করা : ৩০০ গ্রাম
প্রোটিন : ৭৫ গ্রাম
ফ্যাট : ৫৬ গ্রাম
সকাল : (৮টা-৮.৩০ এর মধ্যে) আটার রুটি- ১২০ গ্রাম (৪টা ছোট পাতলা)
ডিম- ১টা অথবা ডাল
সব্জি- ইচ্ছামতো
ফল- ইচ্ছামতো। যেমন : আমড়া, পেয়ারা
সকাল ১১টায় : (অবশ্যই খাবেন) মুড়ি বা বিস্কুট- ৩০ গ্রাম
মিষ্টি ফল- দিনে যে কোন ১টি। যেমন : আম/আপেল/পেয়ারা
দুপুর : (২টার মধ্যে) ভাত ৪ কাপ
মাছ বা মাংস – ৬০ গ্রাম (২ টুকরা)
ডাল- ৩০ গ্রাম (২ কাপ মাঝারি ঘন)
সব্জি- ইচ্ছামতো
শাক-সালাদ-লেবু
বিকাল : (৫টা-৬টার মধ্যে) দুধ- ১২০ মিলি লিটার (১ কাপ)/ দই ১ কাপ/ বাদাম ৩০ গ্রাম/ পনির/ ছানা
(অথবা ডাল বা চিনাবাদাম = ৩০ গ্রাম)
রাতের খাবার : (৯টার মধ্যে) আটার রুটি- ১৫০ গ্রাম (৪টা ছোট পাতলা) অথবা ভাত ভাত ৩ কাপ
মাছ বা মাংস- ৩০ গ্রাম (১ টুকরা)
ডাল- ৩০ গ্রাম (২ কাপ মাঝারি ঘন)
সব্জি ইচ্ছামতো
একবেলা রোগীর সুবিধামতো সময়ে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটতে হবে। হাঁটা ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ঔষধের মতো কাজ করে।
মনে রাখা খুবই জরুরি
* দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
* প্রতিমাসে ফলোআপে আসতে হবে।
* ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ শুরু/ বন্ধ করা যাবে না।
* পুষ্টিবিদের পরামর্শেই খাদ্যের তালিকা মানতে হবে।
* বিশেষ বিশেষ অবস্থায় যেমন : রমজানে, হজ্বে, গর্ভাবস্থায়, জ্বরে এবং বিশেষ কোনো রোগের খাদ্য ব্যবস্থা পুষ্টিবিদের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
ডায়াবেটিস রোগে নিষিদ্ধ খাবার
চিনি, গুড় দিয়ে তৈরি করা খাবার যেমন : মিষ্টি বিষ্কুট, কেক, পেষ্ট্রি, আইসক্রিম ও চকোলেট।
আর দেরি নয়, আজই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন এবং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কৌশল জেনে নিন।
লেখক : ডেপুটি ডাইরেক্টর, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল
Discussion about this post