অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত
গত বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালের মে মাসের দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি হয়েছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই চিঠিতে প্রস্তাব দেয় তামাক কোম্পানির পণ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হোক। জবাবে শিল্প মন্ত্রণালয় বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দেয়। তারা করোনা মহামারীতে তামাক শিল্পের সাথে জড়িতরা ‘কোথায় যাবে, কী খাবে’ তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই খাতে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের পুনর্বাসন কৌশল নির্ধারণের জন্য সময় চায়। ফলাফল, সবকিছু সেখানেই থেমে আছে। কিন্তু ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। সেটি বাস্তবায়নে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রয়োজন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে আমরা সেই পথে খানিকটা হলেও এগিয়ে থাকতাম। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে অগ্রগতি হতো। কিন্তু আমরা তা থেকে বঞ্চিত হলাম। এমন নানাভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যা, মূল লক্ষ্য অর্জনে আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
২০২০ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল, ধূমপায়ীদের মধ্যে করোনা পরবর্তী জটিলতা ১৪ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এবার একটু সাম্প্রতিক করোনা বিষয়ক গবেষণায় আসি। ২০২১ সালের আগস্টে একই সংস্থার নতুন এক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত হয়ে যারা হসপিটালে ভর্তি ছিলেন, তাদের মধ্য ধূমপায়ীদের মৃত্যুহার ও করোনা পরবর্তী জটিলতা অনেক বেশি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও এই কাজটিই করতে চেয়েছিল। শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তামাক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা এবং তামাক সেবনের মাধ্যমে সংক্রমণ যাতে না ছড়াতে পারে তা নিশ্চিত করে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা। তাছাড়া চলতি বছরের শুরু থেকে জুলাই-আগস্ট পর্যন্ত দেশে করোনায় যে শতাধিক মৃত্যু আমরা দেখেছি, তার পিছনে তামাকের যথেচ্ছ ব্যবহারের দায় যে ছিল না; তা কী আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি? সম্ভবত, না।
বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের ৩ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করে। তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর ১ লাখ ৬২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, যার অর্থনৈতিক মূল্য ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা, বা জিডিপির ১.৪ শতাংশ। এই সকল বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করা জরুরী। বাংলাদেশ তাতে একমত বলেই ২০০৩ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয় এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে সংশোধিত হয়। কিন্তু গত ৬ বছরে এই আইনের সংশোধন আবারও জরুরী হয়েছে। আইনের ফাঁক দিয়ে তামাক ব্যবসায়ীরা নতুন নতুন পথ ধরেছে, যার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের পথ বন্ধুর হয়েছে। সে কারণে নতুন সংশোধিত আইনে, পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা, বিক্রয়স্থলে তামাক দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, খুচরা বিক্রি বন্ধ করা, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কতার উপর জোর দেওয়া এবং সি-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি) নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলো সামনে এসেছে।
এই বছরটিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। সরকারি সংস্থা ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো বরাবরের মতো কাজ করেছে। তবে সংসদ সদস্যবৃন্দ তামাক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে এক রকম চেপে ধরেছেন সবাইকে। ‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ এন্ড ওয়েল বিয়িং’ শীর্ষক সংসদীয় ফোরামের তত্ত্বাবধানে ১৫২ জন সংসদ সদস্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের পক্ষে মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর চিঠিতে স্বাক্ষর করে। দলমত নির্বিশেষে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক দারুণ উদাহরণ। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আন্তরিক। তিনি সংসদ সদস্যদের এই দাবি বাস্তবায়নে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও উল্লেখ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ে এ ব্যাপারে বার্তা দেওয়া হয়েছে। সশরীরে গিয়ে এ ব্যাপারে এডভোকেসি করা হয়েছে। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ যে অর্জনটি হয়েছে, তা হলো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের গুরুত্ব নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আইন প্রণেতাদের হাত ধরে ছড়িয়ে দেওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের আন্তরিকতার শেষ নেই। কিন্তু কোথায় কীভাবে যেন, সবকিছু বোধ করি একটু ধীর লয়ে চলছে। তাতে তামাক কোম্পানিগুলো নতুন পথ খোঁজার সময় পাচ্ছে, আমরাও লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়ছি। আমরা জানি, আইন সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। এ বিষয়গুলো একদিনে যেমন শেষ করা সম্ভব নয়, তেমনই আবার অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও দেখা জরুরী। একজন কর্মকর্তা একটি অধিদপ্তরে এসে যখন কোন একটি বিষয় নিয়ে অনেকটা পথ এগিয়েছেন, তখন তিনি অন্য অধিদপ্তরে বদলি হলে প্রক্রিয়াটি আবারও পিছিয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়। সিদ্ধান্ত নিতে পারার পদাধিকার ভিত্তিতে এবং কার্যকারিতার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পর্যায়গুলোতে কর্মকর্তাদের আসীন থাকলে এ ধরণের কাজ গতি পাবে বলে বিশ্বাস করি।
আইন সংশোধন করে তামাক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি একটি জাতীয় ম্যান্ডেট। জানতে পেরেছি, ইতোমধ্যে খসড়া প্রস্তুতের কাজ চলছে। এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। এই খসড়ায় এতোদিন ধরে বলে আসা দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। সেটি না হলে, এত আন্দোলন, গবেষণা, সংসদে দাবি জানানো; বৈঠক আর সবার প্রচেষ্টা পণ্ডশ্রম হবে। আমরা তা চাই না। কারণ এই সংশোধিত আইন শুধু বর্তমানের নয়; বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পথে বড় অর্জন হবে। তাই এই প্রক্রিয়াটি দীর্ঘায়িত না হোক, তা মনেপ্রাণে চাই। কারণ, একটি আইন খসড়া করলেই এর কাজ শেষ হয় না। সেটিকে চূড়ান্ত করা এবং পাশ করাতে সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে আমাদের হাঁটতে হবে লম্বা পথ। অন্যদিকে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ২০৪০ অনুযায়ী আমাদের হাতে আছে মাত্র ১৯ বছর। এতো বড় লক্ষ্য, এতো শক্তিশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে সময়টা খুব একটা বেশি নয়। তাই আইন সংশোধন প্রক্রিয়া দ্রুত করা একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: রাজনীতিবিদ
Discussion about this post