ডা. প্রবীর কুমার দাশ
উচ্চ রক্তচাপ এক নিরব ঘাতক। বাংলাদেশে এক চতুর্থাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। তবে জনসচেতনতা, সঠিক পরিমাপ ও শনাক্তকরনের অভাবে তা অনেক সময় দেরীতে ধরা পড়ে। ততদিনে উচ্চ রক্তচাপগ্রস্ত ব্যক্তি হৃদরোগ, ষ্ট্রোক, কিডনী রোগ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই ঘাতক ব্যাধিকে সময়মতো শনাক্ত করতে তার সঠিক পরিমাপ আবশ্যক। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, সঠিক জীবনযাত্রা ও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে উপরোক্ত প্রাণঘাতি রোগ সমূহ প্রতিরোধ সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপের সাথে খাদ্যের যে উপাদানটি সরাসরি জড়িত তা হচ্ছে লবণ।
ধারনা করা হয় সমুদ্রের লবণ পানিতেই প্রাণের অস্তিত্ব প্রথম ধরা পড়ে। মঙ্গল গ্রহে লবনের উপস্থিতিতে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকগণ আশাবাদী হয়েছেন। তাই লবণের সাথে প্রাণের অস্তিত্ব জড়িত। অন্যদিকে তা প্রাণঘাতি হৃদরোগ, ষ্ট্রোক ও কিডনী রোগ সৃষ্টিকারী উচ্চ রক্তচাপের সাথেও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। এখন দেখা যাক এই লবণটা আসলে কি ? লবণ হচ্ছে পুষ্টিগুণহীন একটা অজৈব রাসায়নিক বস্তু যা সোডিয়াম ও ক্লোরাইডের মিলিত যৌগ। সোডিয়াম মস্তিস্ক থেকে স্নায়ুর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে খবরা খবর আদান প্রদান করে। এভাবে মানবদেহে চেতনাশক্তি বজায় থাকে, মাংসপেশী কাজ করে। এছাড়া দেহকোষের বাইরের জলীয় পরিবেশের প্রধান উপাদান সোডিয়াম যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই জীবন ধারনের জন্য সোডিয়াম অপরিহার্য। তবে তা কোন অবস্থানে লবন নয়। সোডিয়াম দৈবক্রমে লবণের একটা মৌল হওয়াতেই এই বিভ্রান্তি। জীবন ধারনের জন্য যে পরিমাণ সোডিয়াম প্রয়োজন তা অনায়াসে অন্যান্য খাদ্য উপাদান থেকে পাওয়া যায়। যেমন উদ্ভিজ্য খাদ্যে প্রচুর সোডিয়াম থাকে যা উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু শরীরে লবণের কি প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় গৃহীত হয়ে থাকে ১০ গুণ বেশী পরিমাণে।
লবণ নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের সন্দেহ সুপ্রাচীন কাল থেকে। খৃষ্টপূর্ব ২৫০০ শতাব্দীতে চিকিৎসকরা সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে খাদ্যে লবণ যত বেশী গৃহীত হবে রক্তচাপও তত বেশী বাড়বে। তার অনেক শতাব্দী পর মানুষ রক্তচাপ পরিমাপ করা শিখেছে। খাদ্যে লবণের পরিমাপ করা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় ফলাফল বিশ্লেষণে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে রক্তচাপ বৃদ্ধির সাথে লবণ সরাসরি সম্পর্কিত।
লবণে উচ্চ রক্তচাপ: কীভাবে?
খাদ্যে গৃহীত লবণকে শরীরে দ্রবীভূত অবস্থায় রাখতে প্রয়োজন পানি। যেমন এক আউন্স লবণের জন্য প্রয়োজনে সাড়ে তিন লিটার পানি। অর্থাৎ এক আউন্স লবণ হৃৎপিণ্ড এবং রক্ত সংবহনতন্ত্র তথা রক্তনালীকে এই সাড়ে তিন লিটার বোঝা চাপিয়ে দেয়। এতে রক্তের আয়তন বৃদ্ধি পায় এবং রক্তনালী সংকুচিত হয়। উভয়ের মিলিত ফলাফল হচ্ছে রক্তচাপ বৃদ্ধি। পরীক্ষায় দেখা গেছে দৈনিক লবণ ১০ গ্রাম থেকে ৫ গ্রামে কমিয়ে আনলে রক্তচাপ ৪–৬ মিমি কমে আসে। এভাবে স্ট্রোকের প্রকোপ শতকরা ২৪ ভাগ এবং হৃদরোগের প্রকোপ শতকরা ১৮ ভাগ কমিয়ে আনা যায়। আর এভাবে বিশ্বজুড়ে ২.৫ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান তাপদাহ ও অনাবৃষ্টিতে পানীয় জলে অতিমাত্রায় লবণের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে রক্তচাপ বাড়ছে। উচ্চরক্তচাপ গ্রস্তদের তা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে এবং হার্ট ফেইলিউর ও অন্যান্য হৃদরোগ ও কিডনী রোগে আক্রান্তদের স্বাস্থ্য সমস্যা জটিল আকার ধারণ করেছে। এগুলো লবণে উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির সরাসরি প্রতিক্রিয়া।
খাদ্যের লবণ
দৈনন্দিন গৃহীত খাদ্যদ্রব্যে লবণ তিনভাবে থাকতে পারে। খাদ্যের নিজস্ব উপাদান হিসাবে, রান্নায় ও টেবিল (পাত্) লবণ হিসাবে এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে। সাধারণত: প্রত্যেক উৎস থেকে এক তৃতীয়াংশ লবণ গৃহীত হয় । যদিও শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় লবণ কেবল প্রথমোক্ত উৎস থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া সম্ভব। শাক সব্জী, ফলমূল, বীজ ও শস্য– এ সবেই প্রাকৃতিক উপাদান হিসাবে রয়েছে লবণ । প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হচ্ছে লবণের লুকানো উৎস । আজকাল প্রক্রিয়াজাত খাদ্য দৈনন্দিন গৃহীত খাবারে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এটা রসনা তৃপ্তির অন্যতম উপাদানও বটে । কিছু প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের গায়ে লবণের পরিমাণ উল্লেখ থাকে। কিন্তু ফাষ্ট ফুড এবং চায়নিজ খাদ্যের লবণের পরিমাণ অজানাই থেকে যায়। বিশ্বের বিখ্যাত প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময় লবণের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে দেখা যায়। তা অবশ্যই ব্যবসায়িক স্বার্থে । রান্না ও টেবিল লবণ অবশ্য দৃশ্যমান । রান্নার লবণ পানির স্ফুটনাংক হ্রাস করে। এতে তাপ সহজে খাদ্যের মধ্যে প্রবেশ করে এবং রান্না সহজ হয় । তবে অভ্যাসবশত: অনেকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি লবণ রান্নায় ব্যবহার করে। আর যারা লবণ বেশী পছন্দ করে তারা খাদ্যের লবণ যাই হোক খাবার টেবিলে বা পাতে আরো একটু লবণ যোগ করে । এভাবে প্রয়োজনের তুলনায় ১০ গুণ বেশি লবণ গৃহীত হয়ে থাকে প্রতিদিন । আপনি যে অনেক বেশি লবণ খেয়ে ফেলেছেন তা বুঝতে পারেন খুব সহজে! একটি খাবার গ্রহণের এক ঘন্টা পর যদি আপনি খুব তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন তবে বুঝবেন আপনি অনেক লবণ খেয়ে ফেলেছেন।
এবার দেখা যাক অতি লবণ সমৃদ্ধ খাদ্য কোন্ গুলো ? নিচের তালিকায় রয়েছে এমন কিছু খাদ্যের নাম–
বেকারী জাত খাদ্য–রুটি, কেক, চিপ্স
দুগ্ধজাত খাদ্য–পনির, বাটার, মার্জারিন
মাছ–নোনা ইলিশ, মাছের কাবাব, গলদা ও বাগ্দা চিংড়ি, ধূমায়িত মাছ,
টিনজাত মাছ ।
মাংস– প্রক্রিয়াজাত সব ধরনের মাংস, রোস্ট, বিরিয়ানী, শিক কাবাব,
বটি কাবাব, হট ডগ
সব্জি– পালং শাক, টিনজাত সব্জি
অন্যান্য– চায়নিজ স্যুপ, সয়াসস্, বেকিং পাউডার, কেচাপ, সালাদ, চাট্নি,
বাখরখানি, সালসা, মুড়ি।
খাদ্যে লবণ সীমিত করবেন কিভাবে ?
উচ্চ রক্তচাপ প্রতিকার ও প্রতিরোধ এবং শরীরের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য খাদ্যে লবণ সীমিত করা আবশ্যক। এটা সম্ভব খুব সহজেই । শুধু প্রয়োজন এক ধরনের সমঝোতা । আপনি আপনার পরিবার এবং নিকটজন সবাই মিলে একটা সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করলে তা সহজেই হয়ে উঠবে। লবণ সীমিত করার প্রথম করণীয় হলো উচ্চ লবণযুক্ত খাবার পরিহার করা। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমদিকে একটু অসুবিধা হতে পারে । তা চালিয়ে গেলে দেখবেন খাবারে লবণ কমিয়ে দেয়া সম্ভব।
এক্ষেত্রে কিছু বাস্তব দিক নির্দেশনা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে–
খাবার টেবিলে কখনই লবণ রাখবেন না ।
খাদ্যের বাইরের লেবেলে উপাদান ও তার পরিমাণ পড়ে দেখুন। তাদের অনেক গুলোতে প্রচুর লবণ থাকে। এগুলো পরিহার করুন। যেসব খাবারে সোডিয়াম লেখা থাকে তাতে অনেক লবণ থাকতে পারে। যেমন– মনো সোডিয়াম গ্লুটামেট (টেস্টিং সল্ট)।
প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষিত খাদ্যের লবণের পরিমাণ দেখে নিন। কম লবণযুক্ত খাদ্য বাছাই করুন।
বাজারজাত খাদ্য ও ওষুধের গায়ে লবণের পরিমাণ সম্বলিত নির্দেশনা পড়ে দেখুন। কিছু কিছু ভেষজ ওষুধে বেশি মাত্রায় খনিজ লবণ থাকে, যা প্রায়শ: উল্লেখ থাকে না। এ ব্যাপারে সচেতনতা ও মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (বি.এস.টি.আই.) তৎপরতা আবশ্যক।
বাইরে খাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করুন। ফাষ্ট ফুড ও চায়নিজ খাবারে অনেক বেশি লবণ থাকে। রেষ্টুরেন্টে আপনি বলেন যে আপনি কম লবণযুক্ত খাবার চান ।
প্রচুর তাজা সব্জি ও ফল গ্রহণ করুন। অন্যান্য উপকার ছাড়াও এগুলোতে যে পটাশিয়াম রয়েছে তা লবণের প্রতিক্রিয়া হ্রাস করবে।
রান্নার সময় লবণ ব্যবহার না করাই শ্রেয়। লবণ যা দিতে হয় তবে তা রান্নার শেষে দিন । তখন আপনি অবশ্যই কম দেবেন ।
আপনি খাদ্যে লবণ সীমিত করার সুফল পেতে পারেন স্বল্প সময়েই । প্রথমত: আপনি দেখবেন যে আপনার হাত পাগুলো সরু হয়ে এসেছে। তাৎক্ষণিকভাবে আপনি উপলব্ধি করবেন লবণ আপনার শরীরটাকে কি রকম স্ফীত করে তুলেছিল। উচ্চ রক্তচাপগ্রস্তদের লবণ সীমিত করলে রক্তচাপ কমে আসে। এতে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধের মাত্রাও কমানো সম্ভব হয় । খাদ্যে লবণ হ্রাসের লক্ষ্য হচ্ছে দৈনিক সোডিয়াম গ্রহণ ১০০ মি: মোল এর নীচে নিয়ে আসা অর্থাৎ দৈনিক ৬ গ্রাম সোডিয়াম ক্লোরাইড কিংবা ২.৪ গ্রাম সোডিয়াম গ্রহণ সুপারিশ করা হয় । খাদ্যের লবণ সীমিতকরণ ফলপ্রসূ হচ্ছে কিনা তা প্রস্রাবে সোডিয়ামের পরিমাণ মাপলে সহজে বোঝা যাবে। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও লবণ সীমিত করলে শরীরের জলীয় অংশ কমে ওজন কমে আসে। এভাবে কয়েকদিনের মধ্যে সহজেই ১–৫ পাউন্ড ওজন কমানো সম্ভব। মেদবহুল ব্যক্তি খাদ্যে লবণ সীমিত করে শরীরের ওজন কমাতে পারেন । এছাড়া এতে হৃৎপেশী মোটা হয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব হয়, যা উচ্চ রক্তচাপে হার্ট এ্যাটাক ও হৃদযন্ত্রের অক্ষমতার ঝুঁকি বাড়ায় । জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে খাদ্যে লবণ সীমিত করা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হিসাবে প্রমাণিত ।
পরিশেষে, বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস ২০২৩ এর প্রতিপাদ্য বিষয়ে সঠিকভাবে রক্তচাপ মেপে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণপূর্বক দীর্ঘায়ু হবার কথা বলা হয়েছে। খাদ্যে লবণ সীমিত করা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ও প্রতিরোধের সবচেয়ে সহজ উপায়। রূপকথায় লবণের মতো ভালোবাসার কথা উদ্ধৃত আছে। আবার লবণের প্রতি ভালোবাসাও রয়েছে অনেকের। লবণের প্রতি এই ভালোবাসা কমান। অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের কুফল সম্পর্কে সচেতন হোন রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করুন দীর্ঘায়ু হোন।
লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।
Discussion about this post