হার্টবিট ডেস্ক
বেসরকারি একটি সংস্থায় অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি নিতে আসেন খুলনা মহানগরীর বাসিন্দা আবু হানিফ (ছদ্মনাম)। তার চার বছরের মেয়ে মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু এইচআইভি পজিটিভ। মায়ের মাধ্যমে মেয়েটি পজিটিভ হয়, তবে বাবা নেগেটিভ। এ বছরই ওই মেয়েটির মা মারা গেছেন। গত এক বছরে খুলনা অঞ্চলে তিনটি শিশু এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে, আর মারা গেছে একটি শিশু। এই শিশুদের বেশিরভাগই এতিম। কারও বাবা-মা দুজনই এইডসে মারা গেছেন। কারও বাবা মারা গেছে, মা পজিটিভ। অভিযোগ রয়েছে, আক্রান্ত এ শিশুরা নিকটাত্মীয়দের কাছে চরম অবহেলা আর ঘৃণার পাত্র।
পরিসংখ্যান বলছে, সীমান্তবর্তী খুলনা অঞ্চলে এইডসের ভয়াবহতা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। ২০২১ সালে খুলনা অঞ্চলে ২৮ জন পজিটিভ শনাক্ত ছিল। ২০২২ সালে এসে পজিটিভ শনাক্ত হন ৬৫ জন। পজিটিভ হচ্ছে শিশুরাও। গত তিন বছরের তুলনায় এ বছর খুলনায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সীমান্তবর্তী হওয়ার কারণে খুলনা অঞ্চলে এইডসের ঝুঁকি বেশি। কারণ পার্শ্ববর্তী দেশে এ রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সীমান্তে অবাধ যাতায়াতের কারণে ঝুঁকিও বেশি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রক্ষণশীল সমাজে মেয়েরা সাধারণত এইচআইভি সংক্রমিত হন তাদের স্বামীর কাছ থেকে। আর মায়ের কাছ থেকে শিশুরা সাধারণত তিনটি উপায়ে এইচআইভি জীবাণুতে আক্রান্ত হয়। গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে এবং বুকের দুধের মাধ্যমে। তবে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে এইচআইভি আক্রান্ত হয়। তাই সন্তান নেওয়ার আগে মায়েদের এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, মা-বাবার কাছ থেকে জন্মগতভাবে শিশুরা এইচআইভি সংক্রমিত হতে পারে। কিন্তু এইচআইভি পজিটিভ হলেই তা এইডস নয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের সুস্থ রাখা সম্ভব। কিন্তু অসচেতনতার কারণে কোমলমতি অনেক শিশু এগিয়ে যায় এইডস এর দিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, অজ্ঞতা, সঠিক ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, আত্মীয়স্বজনের অবহেলা এবং অযত্নের কারণে শিশুরা মরণব্যাধি এইডসের ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাসস্থান, চিকিৎসা আর শিক্ষার সুযোগও তারা পায় না। তাদের অপরাধ একটাই, তারা এইচআইভি পজিটিভ। অনেকের ধারণা তারা এইডস আক্রান্ত শিশু। রোগটি ছোঁয়াচে- এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে তাদের একঘরে করে রাখে প্রতিবেশীরা। সংক্রমণের অমূলক আশঙ্কায় সাহায্য-সহযোগিতায় জন্য পাশেও দাঁড়ান না কেউ।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে ১৫৮ এইচআইভি পজিটিভ রোগী নিয়ে এআরটি কর্নারের যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ৫১৫ জন আইডিভুক্ত এইচআইভি পজিটিভ রোগী আছে। এরমধ্যে ৪১০ জন রোগী নিয়মিত এআরভি গ্রহণ করছেন।
গত এক বছরে খুমেক হাসপাতাল (এআরটি) সেন্টার থেকে খুলনাসহ ১০ জেলায় ৬৫ জনের এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়। এরমধ্যে শিশু রয়েছে তিনটি। এদের দুজনই খুলনার ও অপরজন যশোর জেলার। এই সময়ে পুরুষ ও নারীসহ ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে একটি শিশুও রয়েছে। সে খুলনার বাসিন্দা।
খুমেক হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার ২২১ নম্বর রুমে এআরটি (অ্যান্টি রেক্ট্রোভাইরাল থেরাপি) সেন্টারের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে (২০২১ সালের ২১ নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত) ৯২৩ জনকে এইচআইভি পরীক্ষা করে নতুন করে তিন শিশুসহ ৬৫ জনের শরীরে এইচআইভি শনাক্ত করা হয়। এরমধ্যে পুরুষ ৩৩ জন, নারী ২৯ জন ও শিশু রয়েছে তিনটি। শিশুর মধ্যে কন্যাশিশু রয়েছে দুটি ও ছেলেশিশু একজন। একই সময়ে মারা গেছে ১৮ জন। এরমধ্যে পুরুষ ১০ জন, নারী সাত জন ও ছেলেশিশু একটি। এবছর ৬৫ শনাক্তের মধ্যে খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, যশোর, বাগেরহাট, পিরোজপুর, মাগুরা, ঝালকাঠি, চাঁদপুর ও বরিশালের বাসিন্দারা রয়েছে।
খুলনায় এইডসের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ১ ডিসেম্বর পালিত হয় বিশ্ব এইডস দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘অসমতা দূর করি, এইডসমুক্ত বিশ্ব গড়ি’।
খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, বর্তমানে এই হাসপাতালে অন্তঃসত্ত্বা কোনও নারীর প্রসব করালে তাকে বাধ্যতামূলক এইচআইভি পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এছাড়া এইচআইভি পজিটিভ রোগীদের বিনামূল্যে অনেক দামি ওষুধও দেওয়া হচ্ছে।
খুমেক হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার (মেডিসিন) এবং এআরটি কর্নারের ফোকালপারসন ডা. দীপ কুমার দাস বলেন, যেসব অন্তঃসত্ত্বা মা এইচআইভি পজিটিভ, কিন্তু তারা জানতে পারেননি তাদের ক্ষেত্রে গর্ভের শিশুটির ঝুঁকি বেশি থাকে। অনেক সময় শিশু মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ে। যদি অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় ওই পজিটিভ মা নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, সেক্ষেত্রে শিশুটির এইচআইভি পজিটিভ না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনেক ক্ষেত্রেই এইচআইভি পজিটিভ অন্তঃসত্ত্বা মা টিবি পজিটিভও হয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে আমরা একইসঙ্গে দুই ওষুধ রোগীকে সেবন করাতে পারি না। তাতে শিশুটি ঝুঁকিতে থাকে।
২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে খুলনাসহ ১০ জেলায় এইচআইভি পজিটিভ বেশি পাওয়া গেছে বলেও জানান এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ২০২১ সালে এইচআইভি পজিটিভ ছিল ২৮ জন। ২০২২ সালে ৬৫ জন এইচআইভি পজিটিভ হয়। সরকার এদের বিনামূল্যে দামি ওষুধ প্রদান করছে। ওষুধ দেওয়ার আগে এআরটি কর্নার থেকে সব ধরনের রুটিন টেস্টই বিনামূল্যে করা হয়। সচেতনতা ছাড়া এই রোগে প্রতিরোধ করা সম্ভব না বলেও মনে করেন তিনি।
খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টারের কাউন্সিলর কাম-অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দিবেশ ওঝা বলেন, গত এক বছরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ (খুমেক) হাসপাতাল এরআরটি সেন্টার থেকে এইডস পরীক্ষা করে খুলনাসহ ১০ জেলায় শিশুসহ ৬৫ জন নতুন করে এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। এ সময় মারা গেছেন ১৮ জন। শনাক্তের মধ্যে খুলনায় ২৮ জন, নড়াইলে ৯ জন, বাগেরহাটে আট জন, সাতক্ষীরায় সাত জন, যশোরে সাত জন, পিরোজপুরে এক জন, মাগুরায় এক জন, ঝালকাঠিতে দুই জন, চাঁদপুর ও বরিশালে একজন করে রয়েছেন। শনাক্তদের মধ্যে তিনটি শিশু রয়েছে। এর মধ্যে দুটি খুলনার, অপর শিশুটি যশোরের।
এ বছর এই অঞ্চলে শিশুসহ ১৮ জন মারা গেছেন উল্লেখ করে তিনি জানান, এর মধ্যে খুলনার রয়েছে এক শিশুসহ আট জন (পুরুষ চার জন, নারী রয়েছেন তিন জন এবং শিশু একটি), পিরোজপুরে এক জন নারী, নড়াইলে দুই জন পুরুষ ও একজন নারী, যশোরে দুই জন পুরুষ ও দুই জন নারী এবং বাগেরহাটে দুই জন পুরুষ।
খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টার সূত্রে জানা যায়, এখান থেকে আইডিধারী এইচআইভি রোগীর সংখ্যা ৫১৫ জন। এরমধ্যে এইডসে মারা গেছে ৪৫ জন। নিয়মিত রোগী আছে ৪১৪ জন। অনিয়মিত রোগী আছে ৪৫ জন এবং এখান থেকে রেফার করা হয় ১২ জনকে। উল্লেখ্য, এইচআইভি পজিটিভের মধ্যে সেক্স ওয়ার্কার ৯৩ জন, এমএসডব্লিউ জনগোষ্ঠীর ৪৪ জন, এমএসএম আছে ৩৯ জন এবং সাধারণ জনগোষ্ঠী রয়েছে ৩০১ জন। গত তিন বছরের চেয়ে ২০২২ সালে এ সেন্টার থেকে ৯২৩ জনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ৬৫ জন এইচআইভি শনাক্ত হয়। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। এর আগের বছর ২০২১ সালে ৯২৩ জনকে এইচআইভি পরীক্ষা করে পজিটিভ হয়েছিল ২৮ জন, ২০২০ সালে ৮২০ জনের পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত হয় ৩২ জন এবং ২০১৯ সালে ৫৩৫ জনের মধ্যে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছিল ৪২ জনের।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক বছরে খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টার থেকে এইচআইভি পরীক্ষার মধ্যে ২৮ জনের শরীরে এইচআইভি পজিটিভ পাওয়া যায়। এরমধ্যে খুলনার বাসিন্দা ছিল ১৮ জন। এছাড়া যশোরে ছয় জন এবং বাগেরহাটের চার জন। পজিটিভ হওয়ার রোগীর মধ্যে পুরুষ ১৭ জন, মহিলা ৯ জন এবং শিশু ছিল দুই জন। একই সময়ে এইডস আক্রান্ত সাত জন রোগী মারা যায়। মারা যাওয়ার মধ্যে খুলনায় চার জন, বাগেরহাটে দুই জন এবং নড়াইলে একজন ছিল। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ চার জন, নারী দুই জন এবং শিশু একটি।
এক বছরে খুমেক হাসপাতালের এআরটি সেন্টারে রেফার রোগীর সংখ্যা ছিল ২৪ জন। এ সময়ে এআরটি সেন্টারের সেবা গ্রহণকারী ৪৩৬ জনের মধ্যে ২২৫ জন পুরুষ ও ২০৮ জন নারী ছিল। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক ছিল তিন জন। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ কেন্দ্রের আওতায় এইচআইভি জীবাণু বহনকারী ছিল ৪৩৫ জন। এরমধ্যে খুলনার ১৪৯ জন, যশোরের ১০৬ জন, সাতক্ষীরার ৫৫ জন, বাগেরহাটের ২৬ জন, বরগুনার দুজন, বরিশালের একজন, চুয়াডাঙ্গার পাঁচ জন, ফরিদপুরের চার জন, ঝিনাইদহের ১৩ জন, গোপালগঞ্জের আট জন, ঝালকাঠির একজন, মাদারীপুরের একজন, মাগুরার ১০ জন, নড়াইলের ৪৬ জন, পটুয়াখালীর একজন, পিরোজপুরের চার জন, রাজশাহীর একজন এবং জেলা উল্লেখ না করা দুই জন ছিল।সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post