ডা. নাজনীন সুলতানা
বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা। কারণে-অকারণে প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে শিশু। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধিতার হার ৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। জন্মের আগ থেকে বাচ্চার মা-বাবা সতর্ক হলে কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধিতা রোধ করা সম্ভব।
শিশুদের প্রতিবন্ধকতা
শিশুদের মধ্যে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে- শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা। সময় মতো হাটতে না পারলে বা বসতে না পারলে এটা হবে শারীরিক প্রতিবন্ধীতা। কথা বলতে পারে না বা চোখে দেখতে পারে না এটাও প্রতিবন্ধকতা। বয়স অনুযায়ী স্বাভাবিক যা পারার কথা, তা না পারলেই সেটা হবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা। এটা ধরতে একটু কষ্ট হয়। অনেক সময় বাবা-মাও বুঝতে পারে না। স্কুলে যাওয়ার বয়সে প্রকাশ পায়। অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারাও বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা।
কি কি কারণে হতে পারে?
যেকোনো সমস্যা সমাধানের অনুসন্ধ্যান করলে সমাধানে চলে আসা যায়। একটা শিশুদের গড়ে তোলার জন্য জন্মের প্রথম দিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাচ্চা যখন মায়ের পেটে থাকে, বাচ্চার যথোপযুক্ত যত্ন নিতে হবে। মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের পুষ্টি থেকে বাচ্চা পুষ্টি পেয়ে থাকে। আমিষ, স্নেহ ও শর্করা জাতীয় খাবার খেতে হবে। আয়রন, আয়োডিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, গ্লুকোজ ঠিক থাকতে হবে। শিশুর মায়ের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। গর্ভকালীন সময়ে মাকে সম্পূর্ণ ড্রাগ থেকে মুক্ত থাকতে হবে। এ ছাড়া মাকে কোনো মানসিক চাপ নেওয়া যাবে না। মায়ের দুশ্চিন্তা পেটের বাচ্চার উপর নেগেটিভ প্রভাব পড়ে।
মায়ের কাছ থেকে সংক্রমিত হতে পারে, এমন ভাইরাস থেকে সতর্ক থাকতে হবে। যেমন- হাম, রুবেলা, সাইটো মেগালো। এই ভাইরাসগুলো মায়ের কাছ থেকে বাচ্চার উপর প্রভাব পড়ে। সেইসাথে বাচ্চা পেটে ধারণ করার নির্দিষ্ট বয়স থাকতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেওয়া যাবে না এবং অনেক দেরিতেও বাচ্চা নেওয়া যাবে না। বিপরীত করলেই বাচ্চা প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য মায়ের বয়সও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের শারীরিক গঠনও ঠিক মতো আছে কিনা, তাও নিশ্চিত করা দরকার। সেজন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হবে। বাচ্চার জন্মের প্রথম মিনিটের মধ্যে কাঁদবে। এই কান্না নিশ্চিত করতে হবে। আর না হয় বাচ্চা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ঠিক মতো বাচ্চার ডেলিভারি হতে হবে।
বাচ্চার খাবার
জন্মের সাথে সাথে বাচ্চা খাবে শাল দুধ। এই দুধ বাচ্চার শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তৈরি করে। মায়ের দুধের মাধ্যমে বাচ্চার অ্যান্টিবডিগুলো তৈরি হয়। প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। মায়ের দুধ বাচ্চার ব্রেনের জন্য খুবই উপকারী। দুধ পান করানোর মাধ্যমে বাচ্চা মায়ের কাছ থেকেও উদ্দীপনা পায়। ছয় মাস পর থেকে এক বছর পর্যন্ত দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারের প্রতি অভ্যস্ত করতে হবে। এক বছর পর থেকে ঘরের খাবারটাকে বাচ্চার প্রধান খাবার হিসেবে দিতে হবে। দুই বছর পর থেকে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো যাবে না। এই অনুযায়ী চলতে হবে। সেইসাথে বাচ্চার সকল টিকা দিতে হবে। আর এই সময়ে বাচ্চার সাথে থেকে বিভিন্ন বিষয় শেখাতে হবে।
বাচ্চা যতটুকু খেতে পারে, ততটুকু খাওয়াতে হবে, আর জোর করে কিছু খাওয়ানো যাবে না। আজ-কালের মায়েরা বাচ্চাকে খাওয়াতে হাতে একটা মোবাইল বা স্ক্রিন জাতীয় কিছু একটা দেওয়া হয়, তাতে বাচ্চা বেশি খায়। এখানে বাচ্চার অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর বাচ্চাকে বলে বলে মা খাওয়ালে মায়ের কাছ থেকে বাচ্চা অনেক কিছু শিখতে পারতো, কিন্তু মোবাইল বা স্ক্রিন দেওয়ার কারণে এটি আর হচ্ছে না। এতে বাচ্চা এক কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। কারও সাথে মিশতে পারে না, ঠিক মতো কথা বলতে পারে না। এটাও আমাদের সমাজের জন্য বড় একটা সমস্যা। এতেও শিশুরা প্রতিবন্ধী হতে পারে।
শিশুর পর্যাপ্ত যত্ন
জন্মের পর থেকে শিশুর পর্যান্ত যত্ন নিতে হবে। প্রথম পাঁচ বছর যে বয়সে যা দেওয়ার কথা, তা দিতে হবে। তাহলে কিছুটা হলেও বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা রোধ করা যায়।
আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে
আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে করলে বাচ্চা প্রতিবন্ধী হতে পারে। আত্মীয়তার মধ্যে বিয়েটাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ে হলে কিছু জেনেটিক কারণও জড়িত থাকে। তবে আত্মীয়তা ছাড়াও শিশু প্রতিবন্ধী হতে পারে। আর জেনেটিক কিছু সমস্যা আমাদের পরিবেশের সাথে জড়িত। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে ভালো খারাপ জিন থাকে।
যেভাবে মা-বাবা বুঝবে বাচ্ছা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিনা?
বাচ্চা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিনা তা সবার আগে বুঝে বাবা-মা। বাচ্চার মা-বাবার উদ্বেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিনা তা খুব দ্রুতই বুঝা যায়। একটা শিশু চার মাসে বয়সে মায়ের সাথে চোখে চোখে তাকিয়ে হাসে। এটাতে বুঝা যায় বাচ্চার ভিশন ঠিক আছে। মা হাসছে, মায়ের সাথে বাচ্চাও হাসছে। তাতে ধরে নিতে হবে বাচ্চার বুদ্ধি ঠিক আছে। আর ছয় সপ্তাহ বয়সে বাচ্চা মুখ দিয়ে আ আ আ শব্দ করে। ছয় মাস হলে বাচ্চা বাবলিং শুরু করে মা-বাবা, দাদা-নানা বলে। পাশে আকর্ষনীয় কিছু থাকলে হাতে ধরার চেষ্টা করে। পাশ দিয়ে তেলাপোকা বা অন্য কিছু যাওয়া ধরলে শিশু ভয় পায়। আর ভয় পাবে এটাই স্বাভাবিক। আর নয় মাস বয়সে পরিচিত কাউকে দেখলে যেতে চাইবে আর অপরিচিত কাউকে দেখতে কাঁদবে। এগুলো হলো বাচ্চার বুদ্ধি। বয়স অনুযায়ী বাচ্চার বিকাশ হবে। এগুলোর ব্যত্যয় হলে বাবা-মা বুঝতে পারবে।
কখন চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হবে
যখনই বুঝা যাবে শিশু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা লক্ষণ আছে সাথে সাথে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে পারলেই ভালো। কারণ ব্রেন বিকশিত হওয়ার একটা সময় থাকে। যে বয়সে যতটুকু বিকশিত হওয়ার কথা, সেটুকু বিকশিত না হলেই সমস্যা।
বুদ্ধি বিকাশে করণীয়
বাচ্চার বুদ্ধি বাড়াতে কিছু কিছু করণীয় রয়েছে। জন্মের পর থেকে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে হবে। পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। সুষম খাদ্য শিশুকে খাওয়াতে হবে। ভাত, মাংস-ডিম বুদ্ধি বিকাশে এসব খাবার কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
Discussion about this post