ডা. নূরজাহান বেগম
শীতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে একটু একটু করে। ধোঁয়া ওঠা পিঠাপুলি আর খেজুর গুড়ের পাশাপাশি শীতকালের শুষ্ক জীর্ণ প্রকৃতির বিরূপ চিত্র মনকে মলিন করে তোলে। সেই সঙ্গে ওত পেতে থাকা নানা রকম অসুখ-বিসুখের পূর্বাভাস একধরনের অস্থিরতাও তৈরি করে; বিশেষ করে ছোট্ট সোনামণিদের অসুখ-বিসুখ নিয়ে মা-বাব এবং পরিবারের অন্যরা বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন এ সময়।
যেসব রোগ হয়ে থাকে
শীতে সাধারণ সর্দিজ্বরের পাশাপাশি শিশুরা ব্রঙ্কিওলাইটিস, নিউমোনিয়াসহ নানা রকম শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগে ভুগতে থাকে। এ সময় বেড়ে যায় অ্যাজমার ভোগান্তি।
সঙ্গে টনসিলাইটিস, সাইনোসাইটিস এবং পেটের বিভিন্ন ধরনের অসুখের প্রাদুর্ভাবও দেখা যায়।
শিশুদের, বিশেষ করে পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের শ্বাসনালি বেশ সংবেদনশীল থাকে। নাক থেকে শুরু করে পুরো শ্বাসনালির ভেতর একটি নরম পর্দা দিয়ে আবৃত থাকে। বাতাসের তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তন কিংবা ধুলাবালি বা জীবাণুর সংস্পর্শে খুব সহজে এই নরম পর্দায় প্রদাহ তৈরি হয়। শ্বাসের পথ সরু হয়ে যায়, কখনো কখনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে তরল পদার্থের নিঃসরণ ও প্রদাহ বেড়ে যায়, যা ব্রঙ্কিওলাইটিস বা নিউমোনিয়ায় রূপ নিতে পারে।
নবজাতকদের এ সময় প্রায়ই নাক বন্ধ থাকে, ঘড় ঘড় আওয়াজ হয়, বুকের দুধ খেতে কষ্ট হয় এবং তারা মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে থাকে। দেখে মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
এ অবস্থায় যা করতে হবে:
- স্যালাইন ড্রপ ঘন ঘন নাকে দিয়ে নাক পরিষ্কার রাখতে হবে। তাতে সহজে শিশুর কষ্ট কমানো সম্ভব।তবে কিছু উপসর্গ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
শান্ত এবং নাক পরিষ্কার থাকা অবস্থায় যদি - দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকে।
- বুকের পাঁজর কিংবা খাঁচা গর্তে ঢুকে যায়।
- নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
- বুকের দুধ টেনে খেতে পারে না।
- প্রস্রাব কমে যায়।
- শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় কিংবা জ্বর আসে।
- শরীরের রং পরিবর্তন হয়ে যায়।
ব্রঙ্কিওলাইটিস শব্দটির সঙ্গে মা-বাবা কম-বেশি পরিচিত হয়ে যান শীত এবং বর্ষাকালে। সাধারণত দুই বছরের নিচের শিশুদের এ রোগটি হয়। হালকা জ্বর-সর্দি দিয়ে শুরু হয় এটি। পরে শিশু কাশিতে ভুগতে থাকে এবং ঘন ঘন শ্বাস-প্রশ্বাস এবং শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো আওয়াজ হতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণে এ রোগ হলেও শিশুদের দেখে সাধারণত অসুস্থ মনে হয় না। তাই এই রোগের আরেক নাম ‘হাসি কাশি বাঁশি’। নিজে নিজেই এ রোগ ভালো হয়ে যায়, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন পড়ে না। নাক পরিষ্কার রাখা, স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি ঘন ঘন বুকের দুধ বা তরল খাবার খাওয়ানো, কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো কিংবা শরীর মোছানো ইত্যাদি হচ্ছে এই রোগের চিকিৎসা। অনেক ক্ষেত্রে কাশি কমতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লেগে যায়। অসুস্থতার অন্যান্য লক্ষণ না থাকলে কাশি নিয়ে ঘাবড়ানোর দরকার নেই। তবে কখনো কখনো মারাত্মক শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে এবং তাঁর পরামর্শে চলতে হবে।
নিউমোনিয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি রেখে নিউমোনিয়ার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তাই শিশুর প্রচণ্ড জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখলে বাসায় অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
অ্যাজমা ও অ্যালার্জি যেসব শিশু আগে থেকেই অ্যালার্জি কিংবা অ্যাজমার রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তাদের জন্য শীতের শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থাপনা, নিয়মিত ওষুধ সেবনের কোনো পরিবর্তন লাগবে কি না, বাসায় কোন ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে এবং কখন হাসপাতালে যেতে হবে—এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা থাকলে অ্যাজমার মারাত্মক কষ্ট কমানো সম্ভব।
ক্রুপ ও এপিগ্লোটাইটিস এই দুটো রোগের উপসর্গ মোটামুটি কাছাকাছি। দ্রুততম সময়ে সঠিক চিকিৎসা না করালে শিশুরা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কখনো কখনো কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের প্রয়োজন হয়।
ক্রুপের লক্ষণ
- এক বা দুই দিনের হালকা সর্দি-জ্বরের পর হঠাৎ করে শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসনালি চেপে ধরলে যে রকম আওয়াজ হয়, সে রকম শব্দ হওয়া।
- কাশির শব্দ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া।
- ছয় মাস থেকে তিন বছরের শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি।
এপিগ্লোটাইটিসের লক্ষণ
- প্রচণ্ড জ্বর।
- দ্রুত গলা বসে যাওয়া।
- ক্রমাগত লালা ঝরা এবং সেই সঙ্গে শ্বাস নেওয়ার সময় শ্বাসনালি চেপে ধরার মতো শব্দ হওয়া।
- শ্বাস নিতে না পারা কিংবা নীল হয়ে যাওয়া।
দুই থেকে সাত বছরের শিশুদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি রেখে এর চিকিৎসার প্রয়োজন।
ডা. নূরজাহান বেগম, স্পেশালিস্ট, পেডিয়াট্রিক আইসিইউ, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ঢাকা
Discussion about this post