ডা. মো. আহাদ হোসেন
আর্থ্রাইটিস শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘আর্থো’ থেকে, যার অর্থ হচ্ছে জয়েন্ট। ‘আইটিস’ শব্দটির অর্থ ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ। আর্থ্রাইটিস বলতে মূলত বিভিন্ন ধরনের জয়েন্টের প্রদাহ বা ইনফ্লামেশনজনিত রোগকে বোঝায়। বিভিন্ন ধরনের জয়েন্টের প্রদাহ বা আর্থ্রাইটিসজাতীয় রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে দুটি রোগ দেখা যায়, সেগুলো হচ্ছে ‘রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস’ ও ‘অস্টিও আর্থ্রাইটিস’।
এই রোগ দুটির পরিপূর্ণ সুস্থতা পাওয়া খুবই দুরূহ। অবশ্য শারীরিক কিছু ব্যায়াম, জীবনযাপন পদ্ধতি, ওজন নিয়ন্ত্রণ ও কিছু ওষুধের মাধ্যমে এই দুটি রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবন পরিচালনা করা সম্ভব।
দীর্ঘমেয়াদি আর্থ্রাইটিস কী
এটি এক ধরনের জয়েন্টের প্রদাহজনিত রোগ। এই রোগে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেমে অজ্ঞাত কোনো ত্রুটির কারণে বিভিন্ন জয়েন্টের আবরণী বা সাইনোভিয়ামকে শত্রু ভেবে সেখানে আক্রমণ করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী সিস্টেম যদি কোথাও আক্রমণ করে, তাহলে সেখানে প্রদাহ তৈরি হয় এবং এই প্রদাহ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। মূলত এই রোগে হাতের বিভিন্ন জয়েন্ট, হাঁটুর জয়েন্ট ও টাকনুর জয়েন্ট খুব বেশি আক্রান্ত হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের শরীরের অন্যান্য অঙ্গ এ ধরনের রোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—চোখ, রক্তপ্রবাহ সিস্টেম, হূিপণ্ড বা হার্ট ও ফুসফুস। কোনো অজানা কারণে এই রোগটি মহিলাদের ক্ষেত্রে বেশি হয় এবং মাঝবয়সীদের ক্ষেত্রে এই রোগটি বেশি দেখা যায়।
কারণ
একজন সুস্থ মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ সিস্টেম শরীরের ভেতরে যেকোনো ধরনের বাইরের এজেন্ট; যেমন—ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রবেশ করতে বাধা দেয়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় যদি কোনো ত্রুটি হয়, তাহলে শরীরের কোনো কোনো বিশেষ অঙ্গকে তারা বাইরের এজেন্ট মনে করে এবং তাদের ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লামেটরি এজেন্ট নিঃসরণ করে। এ ধরনের ঘটনা ঘটে রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রে। এখানে বিভিন্ন জয়েন্টের আবরণী বা সাইনোভিয়ামের বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ইনফ্লামেটরি এজেন্ট বা প্রদাহকারী কেমিক্যাল নিঃসরণ করে, যা জয়েন্টের আবরণীতে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ব্যথা ও ফুলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।
লক্ষণসমূহ
♦ এই রোগের প্রথম ও প্রধান লক্ষণ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে ফুলে যাওয়া ও ব্যথা হওয়া।
♦ সাধারণত হাতের ছোট ছোট জয়েন্ট প্রথম দিকে আক্রান্ত হয়।
♦ সকালের দিকে শরীর আড়ষ্ট থাকে এবং ব্যথা বেশি অনুভূত হয়।
♦ শরীরে একের অধিক জয়েন্ট আক্রান্ত হয়।
♦ শরীরের উভয় দিকের জয়েন্ট সমানভাবে আক্রান্ত হতে পারে।
রোগ নির্ণয় পদ্ধতি
দীর্ঘমেয়াদি আর্থ্রাইটিস রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীকে শারীরিক পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় কিছু ল্যাব পরীক্ষা করতে হয়। রক্তের কিছু পরীক্ষা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইএসআর, অ্যান্টি সিসিপি অ্যান্টিবডি, আরএ ফ্যাক্টর এবং সিআরপি। এসব পরীক্ষা শরীরের ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ বেড়ে যাওয়া নির্দেশ করে। রক্ত পরীক্ষা ছাড়াও এক্স-রে, আলট্রাসনোগ্রাম এবং এমআরআইয়ের মতো পরীক্ষাগুলো রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করে। তবে পূর্ণাঙ্গ রোগ নির্ণয়ের জন্য এসব পরীক্ষার পাশাপাশি অবশ্যই রোগের ইতিহাস এবং সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদি আর্থ্রাইটিস থেকে ভালো থাকার উপায়
♦ প্রথমত, নিজের প্রতি যত্নবান হতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন এবং এসবের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে চিকিৎসককে নিয়মিত অবহিত করতে হবে। নিজে থেকে কোনো চিকিৎসা বাদ দেওয়া বা নতুন কোনো চিকিৎসা শুরু করা এ ধরনের রোগীদের জন্য সঠিক নয়।
♦ শরীরচর্চা এ রোগের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ ধরনের রোগের সাধারণত জয়েন্টগুলো স্টিফ বা শক্ত হয়ে যায়। তাই স্ট্রেচিং এক্সারসাইজগুলো এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, হঠাৎ করে খুব বেশি স্ট্রেচিং করা খারাপ হতে পারে। এ ছাড়া হাঁটা, দৌড়ানো, বাইসাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা রোগীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ শরীরচর্চা।
♦ সঠিক খাদ্যাভ্যাস এজাতীয় রোগ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারে এবং একই সঙ্গে এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রদাহজনিত সমস্যা কমিয়ে রাখতে পারে। ‘ওমেগা-৩’ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ খাবার প্রদাহজনিত সমস্যা কমিয়ে আনতে পারে। এই খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম সামুদ্রিক মাছ, বিশেষ করে স্যামন ও টুনা মাছ অন্যতম। এ ছাড়া কার্বোহাইড্রেট কম পরিমাণ খেয়ে সবজিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার মাধ্যমেও প্রদাহজনিত সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। কার্বোহাইড্রেটজাতীয় খাবারের মধ্যে ফাইবারসমৃদ্ধ কার্বোহাইড্রেট; যেমন—ঢেঁকি ছাঁটা চাল বা বাদামি চাল, ঢেঁকি ছাঁটা গম, ওট ইত্যাদি। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার এ রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারী।
♦ ওজন নিয়ন্ত্রণ করা এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত ওজন শরীরের প্রদাহের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং রিম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। আমাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে শরীরের জয়েন্টগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি হয় এবং ব্যথা বেড়ে যায়। ওজন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য শর্করাজাতীয় খাবার; যেমন—ভাত বা রুটি এক বেলা খাওয়া এবং অন্যান্য খাবার; যেমন—মাছ, মাংস, ডিম, সালাদ, সবজি দুই বেলা বা তিন বেলা খাওয়া।
♦ এই রোগে সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত স্ট্রেস বা মানসিক চাপ শরীরের কিছু হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা শরীরে ইনফ্লামেটরি মেডিয়েটরস বৃদ্ধি করে। ফলে জয়েন্টের ব্যথা অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সকাল ও রাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকালের মুক্ত বাতাসে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট স্বাভাবিক গতিতে হাঁটা মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া অবসরে ভ্রমণে বের হওয়া এবং কাছের মানুষের কাছে নিজের কষ্ট ও দুর্দশাগুলো শেয়ার করার মাধ্যমে মানসিক চাপ কমানো যেতে পারে।
♦ মাঝেমধ্যে শর্ট কোর্স ফিজিওথেরাপি এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য উপকারী হতে পারে। সঠিক জায়গায় সঠিক ফিজিওথেরাপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত জয়েন্টগুলো ফুলে গেলে ঠাণ্ডা কম্প্রেশন ভালো কাজ করে। ঠাণ্ডা কম্প্রেশন দেওয়ার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, ন্যূনতম ১০ মিনিট ঠাণ্ডা কম্প্রেশন দেওয়া উচিত। যদি কোনো জয়েন্ট স্টিফ বা শক্ত হয়ে যায়, তাহলে গরম সেক কার্যকর হতে পারে। অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে কিছু ফিজিওথেরাপি দেওয়া হয়। তবে এটি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিতে হবে।
♦ কর্মক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রেখে চললে যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন, তাঁদের জন্য উপকার হতে পারে। বসার চেয়ারটি একেবারে শক্ত যেমন হওয়া যাবে না, তেমনি খুব বেশি নরমও হওয়া যাবে না। বসার চেয়ারের পেছনের অংশ সামনের দিকে বাঁকানো থাকলে ভালো হয়। দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ না করে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর পাঁচ মিনিটের বিরতি নিয়ে কাজ করা ভালো। যাঁরা কারখানায় কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে একই পজিশনে দীর্ঘক্ষণ কাজ করা পরিহার করে প্রতি ৩০ মিনিট অন্তর পাঁচ মিনিটের বিরতি নিয়ে শরীরের পজিশন পরিবর্তন করে নিতে হবে।
রিম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস ছাড়া অন্য অনেক কারণে আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টের প্রদাহজনিত রোগ হতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে চিকিৎসক সঠিক রোগ নিরূপণ করতে পারলে চিকিৎসায় উন্নতি হয়। সচেতনতা ও সতর্কতা এ ধরনের রোগ থেকে সুস্থ থাকতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক : চিফ কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, ঢাকা
Discussion about this post