হার্টবিট ডেস্ক
রাজধানীর কাজীপাড়ার বাসিন্দা এক বছর বয়সী সাবিত গত সোমবার থেকে জ্বরে ভুগছে। শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকায় বাবা তাকে নিয়ে আসেন শ্যামলীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটে। সেখানে টেস্ট করার পর জানা যায় তার ডেঙ্গু হয়েছে। তাকে চিকিৎসকের পরামর্শে একই হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে এবং বর্তমানে তার অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে বলে জানিয়েছেন তার বাবা।
সাবিতের মতো ৪৫ জন শিশু চিকিৎসাধীন এই হাসপাতালে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৭ জন ভর্তি হয়েছে। এছাড়া আইসিইউতে আছে ৪ জন। এই মাসে দুই শিশু চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। ডেঙ্গু ওয়ার্ড খালি না থাকায় অতিরিক্ত শিশুদের চিকিৎসা হচ্ছে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে।
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০২ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেবার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। সঙ্গে শরীরে ব্যথা মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে দাগ (র্যাশ) হতে পারে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে শরীরের যেকোনো জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। তবে এগুলো না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো যায়।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারিতে ২ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৬ জন, মে মাসে ৯ জন, জুনে ৫১ জন, জুলাইয়ে ১১৫ , আগস্টে ১৪০ এবং সেপ্টেম্বরে এখন পর্যন্ত ১২০ জনের মতো ইতোমধ্যে ভর্তি হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুতে শিশুদের ওপর প্রভাব বেশি। সেপ্টেম্বরে সাধারণত রোগী কমার পর্যায়ে থাকে কিন্তু এবার এখনও কমতে শুরু করেনি। এখানে অন্যান্য হাসপাতাল থেকে রেফার করা রোগী বেশি আসে।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় মে মাস থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার আছে আলাদা, সেখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিনামূল্যে পরীক্ষা করা হয়।
তারা জানান, এবার রোগীদের বোঝা যাচ্ছে না। কারণ হঠাৎ করেই তাদের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। অন্যান্যবার চার-পাঁচদিন বাসায় থাকার পর হয়তো পরীক্ষা করে। কিন্তু এবারের ডেঙ্গুতে দেখা গেছে জ্বর, বমি, লক্ষণ নিয়ে চলে আসছে আর অন্যান্যবার থেকে লক্ষণ একটু আলাদা।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই প্রেশার আমাদের এখানে থাকেই। প্রতি মুহূর্তে আমাদের এখানে রোগী ভর্তি হয় এবং ক্রিটিক্যাল রোগীর একটা চাপের জন্য ১৬টি বেড বরাদ্দ করে রেখেছি। একটা টিম করে দেওয়া হয়েছে, টিমের মাধ্যমে চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। এই টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করে কারণ ডেঙ্গু রোগী আমাদের প্রতি ঘণ্টায় পাল্টে যায়। প্রত্যেক ঘণ্টায় রোগী ফলোআপ করা লাগে। আমাদের এখানে যাদের একটু ওয়ার্নিং সাইন থাকে তাদেরই ভর্তি করি।
তিনি আরও বলেন, গতকাল ৭ জন ভর্তি হয়েছিল তার আগের দিন ১৫ জন। একটু চাপ তো আছেই আমাদের এবং এটা কতদিন থাকবে এখনই বলা যাচ্ছে না। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর এই তিন মাস ডেঙ্গুর মৌসুম। গতবছর করোনার কারণে এরকম প্রাদুর্ভাব হয়নি। ২০১৯ সালে কিন্তু প্রচণ্ড ডেঙ্গু রোগীর চাপ ছিল। আমরা অক্টোবর পর্যন্ত একটু সতর্ক থাকবো। তারপর যদি কমে যায় তাহলে সেটি শিশুদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
পরিচালক বলেন, আমাদের এখানে যদি ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সঙ্গে ওয়ার্নিং সাইন থাকে তাহলেই শুধু আমরা ভর্তি করি। ওয়ার্নিং সাইনের মধ্যে যদি দেখি পেটে ব্যথা, ঘন ঘন বমি, কিছুই খেতে পারছে না, তার সঙ্গে যদি প্রচণ্ড মাথা ব্যথা থাকে , রক্তক্ষরণ শুরু হয় তাহলে আমরা ভর্তি করি। তা না হলে আমাদের এখানে বেড সংকট তো আছেই, আমরা চাইলেই সব রোগী ভর্তি করতে পারি না। তবে আমাদের এখান থেকে এখন পর্যন্ত কাউকে ফেরত পাঠানো হয়নি। আমরা অভিভাবকদের বলে দেই, যখন এই ওয়ার্নিং সাইন দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে যেন নিয়ে আসে। আমরা ডেঙ্গু রোগী কাউকে ফেরত দেই না, যেকোনো মূল্যে বেডের ব্যবস্থা করি।
দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এই বছর এখন পর্যন্ত ৪৮ জন মারা গেছেন ডেঙ্গুতে, যার মধ্যে ২৭ জন সেপ্টেম্বর মাসেই মৃত্যুবরণ করেছেন, তাছাড়া এই মাসে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ হাজার ৬৯৪ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৩টি ওয়ার্ডগুলো হলো – ১, ১১, ১৪, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৯ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৪টি ওয়ার্ড হলো – ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ৩৪, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২, ৪৮, ৫১। এসব এলাকার ১২ শতাংশ বাসা-বাড়িতেই এডিস মশার বিস্তার সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. রোবেদ আমীন জানান, যেসময় থেমে থেমে বৃষ্টি হবে তখনই প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা দেবে। যদি কারও লক্ষণ দেখা দেয় তাদের অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রথম দিন যদি ডায়াগনসিস করা যায় তাহলে সবচেয়ে ভালো। ১০০টি ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ৯০টি মাইল্ড হয়। তারা বাসায় বসেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।
তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর ম্যানেজমেন্টের জন্য শুধু সাধারণ ফ্লুইড যথেষ্ট। যাদের ওয়ার্নিং সাইন নেই তাদের ক্ষেত্রে শুধু জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খেলেই যথেষ্ট, কোনও অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন নেই। যাদের অনেক জ্বর থাকে তারা যেন প্যারাসিটামলের পাশপাশি কিছু লিকুইড খায়। একজন পরিণত মানুষের জন্য ৬-৮ গ্লাস জুস, স্যালাইন, স্যুপ, ডাবের পানি খাওয়াই যথেষ্ট। শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কতটুকু ফ্লুইড লাগবে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৫-৭ দিনে রোগীরা ভালো হয়ে যাবে। ওয়ার্নিং সাইন থাকলে হাসপাতালে যেতে হবে। সব হাসপাতালেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা আছে।সৌজন্যে-বাংলাট্রিবিউন
Discussion about this post