হার্টবিট ডেস্ক
চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ কমছে না। প্রতিদিনই দেড়শ’ থেকে দুইশ’ মানুষ নতুন করে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়রিয়া জটিল পর্যায়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন আক্রান্তরা। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে জেলার ১৫টি উপজেলায় আগস্ট মাসে দুই হাজার ৫৫০ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন।
এছাড়া হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া নগরীর বেশিরভাগ রোগী ছিল ফ্রি পোর্ট, ইপিজেড, পতেঙ্গা, হালিশহর, উত্তর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা। এসব এলাকায় রোগী বেশি হওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন সমুদ্রের জেয়ারের লবণাক্ত পানি এবং ওয়াসার জীবানুযুক্ত পানি পান করা, খোলা ও বাসি খাবার খাওয়া, খাওয়ার আগে হাত না ধোয়াসহ নানা কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৭১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে জেলার ১৪টি উপজেলায় ৯৭, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে ৫২ জন এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের জেলা স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ৯৭ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ১৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে মীরসরাই, সীতাকুণ্ড ও বাঁশাখালীতে ছয় জন, সন্দ্বীপ ও রাউজানে তিন জন, ফটিকছড়ি ও রাঙ্গুনিয়ায় আট জন, হাটহাজারী ও চন্দনাইশে পাঁচ জন, সাতকানিয়ায় চার জন, বোয়ালখালীতে ১১ জন, আনোয়ারায় ১২ জন, পটিয়ায় ১৪ জন, চন্দনাইশে ১০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন।
তিনি আরও জানান, আগস্ট মাসে দুই হাজার ৫৫০ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী উপজেলার ১৫টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৮ মাসে উপজেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ হাজার ১২৭ জন। ১৫টি উপজেলায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ২৮৪টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। মজুত রয়েছে স্যালাইনসহ ডায়রিয়ার প্রয়োজনীয় ওষুধ।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রতি বিআইটিআইডি হাসপাতালে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ রোগীই ছিল নগরীর ফ্রি পোর্ট, ইপিজেড, পতেঙ্গা, হালিশহর, উত্তর আগ্রাবাদ এলাকার বাসিন্দা। কী কারণে এসব এলাকায় ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেশি তা পরীক্ষার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি টিম চট্টগ্রামে এসেছিল। এ টিম নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনও পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।’
বোয়ালখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সব্যসাচী নাথ বলেন, ‘একজন মানুষ নানা কারণে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। ভর্তি রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবানুযুক্ত পানি পান এবং খাওয়ার আগে হাত না ধোয়াসহ নানা কারণে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ কারণে বাসি খাবার খাওয়া থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি খাবার পানি ফুটিয়ে পান করা এবং যে কোনও খাবার খাওয়ার আগে হাত ভালভাবে ধোয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল বারেক বলেন, ‘গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের মাঝে ব্যাপক আকারে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। প্রত্যেক এলাকায় মাইকিং করতে হয়েছিল। ডায়রিয়া থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রচারণা চালানো হয়। এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করা হয়। ডায়রিয়া আক্রান্ত অনেক লোককে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়ছিল। আমি নিজেও ৮-১০ দিন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিলাম। আমরা ওয়াসার পানি পান করি। ওয়াসার পানি থেকে ডায়রিয়া হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে আমি নিজেই ওয়াসা কর্মকর্তাদের বলেছি। যাতে তারা আমার এলাকায় পানি পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেন।’
সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি’ সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমুদ্রের জোয়ারের লবণাক্ত পানি পান করা, খাবার গ্রহণে অসচেতনতাসহ নানা কারণে তারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।’
এদিকে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘ওয়াসার পানির কারণে লোকজন অসুস্থ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও নগরীর হালিশহরসহ কয়েকটি এলাকায় ওয়াসার পানি পানের কারণে ব্যাপক আকারে জন্ডিস ছড়িয়ে পড়েছিল। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়। পরে দেখা গেছে, ওয়াসার পাইপ লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজের লাইন যুক্ত হয়ে পানি দূষিত হচ্ছে। আর এ দূষিত পানি পান করে মানুষ জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমার মনে হয়, এবারও একই ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিন আগেও আদালতের নির্দেশে ওয়াসার পানি পরীক্ষায় ক্ষতিকারক জীবাণু মিলেছে। বর্তমানে ওয়াসার পানির সিস্টেম লস প্রায় ৩২ শতাংশ। এসব সিস্টেম লস হওয়ার অন্যতম কারণ পাইপলাইন ফুটো হয়ে পানি বের হওয়া। ফুটো পাইপলাইন দিয়ে ময়লা-আবর্জনা ঢোকা। এতে লোকজন ডায়রিয়াসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’
তবে ওয়াসার পানির পানে ডায়রিয়া হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম। তিনি বলেন, ‘নগরীর কিছু এলাকার লোকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানার পর ওয়াসার পক্ষ থেকে পানি পরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেখানে ওয়াসার পানিতে এমন কোনও জীবাণু পাওয়া যায়নি যা ডায়রিয়ার কারণ হতে পারে। ওয়াসার পানি থেকে ডায়রিয়া হচ্ছে না। অন্য কোনও কারণে এ রোগ হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরীর ওইসব এলাকার অনেক স্থানে ওয়াসার পাইপলাইন কিংবা সংযোগ নেই। সেখানকার লোকজন টিউবয়েলের পানির পাশাপাশি ড্রামের পানি কিনে পান করেন। তবে অসুস্থরা বলেছেন, তারা নাকি ওয়াসার ড্রামের পানি কিনে পান করেছেন। কিন্তু ওয়াসা ড্রামে করে কোনও পানি বিক্রি করে না।’সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post