ডা. মো: শওকত এমরান, এমবিবিএস, এমডি (নিউরোলোজী), নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ
মানবশরীরের নীরব এক ঘাতকের নাম হাই প্রেসার বা উচ্চ রক্তচাপ। বিশ্বে ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি চারজনে একজন ভুগছেন উচ্চ রক্তচাপে। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। রক্তস্রোত রক্তনালীর দেওয়ালে যে চাপ সৃষ্টি করে সেটিই রক্তচাপ।
তাই আজকে আমরা জানবো এই রোগ নিয়ে জানা অজানা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর ।
প্রশ্ন: আমার ঘাড়ে প্রায় সময় ব্যথা করে। আমার কি হাই প্রেসার হয়েছে?
উত্তর: ঘাড় ব্যথা মানেই প্রেসার হয়েছে ব্যাপারটা ঠিক না। ঘাড় ব্যথার আরো অনেক নানাবিধ কারণ আছে। সাধারণত প্রেসার বেড়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে কারো কারো অস্থির লাগে, বুক ধড়পড় করে, মাথা ঘুরায়, মাথা ব্যথা করে, ঘাড় ব্যাথা করে।
প্রশ্ন: কি লক্ষণ দেখে বুঝব আমার হাই প্রেশার হয়েছে?
উত্তর: সাধারণত প্রেসার বেড়ে গেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ থাকে না। তবে কারো কারো অস্থির লাগে, বুক ধড়পড় করে, মাথা ঘুরায়, মাথা ব্যথা করে, ঘাড় ব্যাথা করে, কান গরম হয়।
প্রশ্ন: আমার বয়স কম, আমার কেন প্রেসার বেড়ে গেল?
উত্তর: সাধারণত হাই প্রেসার বয়স্কদের (৪০ এর পর) রোগ। তবে ইদানিং দেখা যাচ্ছে কম বয়সীদের মাঝেও প্রেসার বেড়ে যায়। এটার কারণ হতে পারে জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস। এছাড়া অন্যান্য কিছু রোগের কারণেও প্রেসার বেড়ে যায়, যেমন: কিডনি জনিত রোগ এবং হরমোন জনিত রোগ।
প্রশ্ন: হাইপ্রেশার কেন হয় ?
উত্তর:
.খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া
.শরীরের অতিরিক্ত ওজন
.চর্বিযুক্ত ও তেলে ভাজা খাদ্য অধিক গ্রহণ
.চাপযুক্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপন।
.নিয়মিত হাটাহাটি ও ব্যায়াম না করা
.ধুমপান ও মদ্যপান করা
.রাতজাগা বা অনিদ্রা
.উচ্চরক্তচাপের পারিবারিক ইতিহাস
.কিছু রোগ ও ঔষধ সেবনের প্রতিক্রিয়া
প্রশ্ন: ১৪০/৯০ এটা কি হাই প্রেশার? প্রেশারের মাত্রা কত হলে ডাক্তার দেখাতে হবে?
উত্তর: না, সাধারণত ১২০/৮০ নরমাল প্রেশার ধরা হলেও ১৪০/৯০ পর্যন্ত তা সহনীয়।এটাকে আমরা হাই প্রেশার বলতে পারিনা।তবে এ মাত্রা অতিক্রম করলেই হাই প্রেশার ধরে নিতে হবে।লক্ষণ দেখা যাক আর না যাক ডাক্তার দেখাতে হবে।
প্রশ্ন: ওষুধ না খেয়ে প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা কি সম্ভব?
উত্তর: সম্ভব। প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধ ছাড়াও খাদ্যাভাস ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে একসময় ওষুধ ঠিকই দরকার হয়।
প্রশ্ন: আমার হাই প্রেসার হওয়ার কারণে আমি কিছুদিন ওষুধ খেয়েছিলাম। পরে মেপে দেখি আমার প্রেসার নরমাল হয়ে গেছে। এখন আমি ওষুধ বন্ধ করে দিতে পারব?
উত্তর: কখনোই না।অনেকেই না জেনে এই ভুলটি করে থাকেন। প্রেসার নরমাল হলেও ওষুধ খাওয়া অবস্থায় হঠাৎ করে বন্ধ করে দিলে প্রেসার অনেক বেশি বেড়ে যায়। এবং ওই সময়ই ব্রেন স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
প্রশ্ন: হাইপ্রেশারের ঔষধ খাওয়ার পর রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে কমে গেলে তখন কি করণীয় ?
উত্তর: যাঁরা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খাচ্ছেন, তাঁরা অনেক সময় একটু কমের দিকে রক্তচাপ পেলে ভয়ে ওষুধ বন্ধ করে দেন। প্রেশার ১২০/৮০ এর কিছু নীচে নামলেও বড় কোন সমস্যা নয়।ওষুধ বন্ধ করা ঠিক না। দরকার হলে ওষুধ বা এর মাত্রা পরিবর্তন করার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন না। তবে রক্তচাপ বেশি কমে গিয়ে কারও সমস্যা হলে বা কোনো উপসর্গ দেখা দিলে, সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে চিকিৎসা নিতে হবে।
প্রশ্ন: আমার শারীরিক কোনো লক্ষণ নেই, এমনিতে প্রেশার মেপে দেখেছিলাম, প্রেসার বাড়তি। আমারও কি ওষুধ খেতে হবে?
উত্তর: খেতে হবে। প্রেসার বাড়তি হওয়ার কোন লক্ষণ না থাকলেও ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ হাই প্রেসার একটি নীরব ঘাতক।
প্রশ্ন: ডাক্তার সাহেব অনেক সময় দুটি প্রেশারের ঔষধ দিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে প্রেশার নরমাল হয়ে আসলে যে কোন একটি কি বন্ধ করা যাবে?
উত্তর: আধুনিক চিকিৎসায় ডাক্তাররা প্রেশার নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় দুটি ওষুধ দিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই দটি ওষুধ মিলেই্ আপনার প্রেশার নিয়ন্ত্রণে এনেছে।তাই হঠাৎ একটি ওষুধ বন্ধ করা যাবেনা। তবে আপনার প্রেশার যদি নরমালের চেয়েওে বেশ কমে যায় তখন অবস্থা বুঝে অভিজ্ঞ ডাক্তার একটি ওষুধ বাদ দিতে পারেন।
প্রশ্ন: হঠাৎ হাইপ্রেশার হলে তৎক্ষণাৎ করণীয় কি?
উত্তর: হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে গেলে তাঁকে অবশ্যই বসে বা শুয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কেউ কেউ মাথায় পানি দিয়ে আরাম পেতে পারেন। অনেকে তেঁতুলের শরবত খেয়ে থাকেন। তবে মনে রাখা প্রয়োজন তেতুলের শরবত বা লেবুর শরবত যাই খান না কেন লবণ ছাড়া খেতে হবে।
প্রশ্ন: হঠাৎ হাইপ্রেশার হলে অনেকে ওরস্যালাইন খেতে বলেন, এটা কি সঠিক ?
উত্তর: একবারেই না। স্যালাইনে লবণ থাকে এটি প্রেশার বাড়াতে সাহয্য করে ।বরং লো প্রেশারে এটি খাওয়ানো যেতে পারে ।
প্রশ্ন: হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গিয়ে খারাপ লাগলে কি তখনই কোন প্রেশারের ওষুধ খেতে পারবো?
উত্তর: না। এটি উচিত নয়। যাদের আগে থেকে প্রেশারের সমস্যা ছিলো বা আপাতত ওষুধ বন্ধ আছে তারা প্রেসক্রিপশনে দেয়া ওষুধ খেতে পারেন কিন্তু নুতন রোগীর ক্ষেত্রে এটি একদমই উচিত নয়।প্রচন্ড মাথা ব্যাথা, চোখ ঝাপসা বা অবশ অবশ ভাব মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: হাই প্রেসার হলে কি কি নিয়ম মেনে চলতে হবে?
উত্তর: হাই প্রেসার হলে নিম্নলিখিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। যেমন: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট করে একটানা দ্রুত হাঁটা, যাতে শরীরে ঘাম দেয়; লবণ খাওয়া কমাতে হবে; চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে; হবে মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে; এবং ডুবো তেলে পোড়া তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ধুমপান ও মদপান পরিহার করতে হবে।
প্রশ্ন: হাই প্রেশার না হওয়ার জন্য আগাম করণীয় কি কি?
উত্তর: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট একটানা দ্রুত হাঁটতে হবে এবং ব্যায়াম করতে হবে, যাতে শরীরে ঘাম হয় ।
. লবণ খাওয়া কমাতে হবে
. অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
. ওজন কম রাখতে হবে। তাই চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে; হবে মিষ্টি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
. ডুবো তেলে পোড়া তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
. রাতে সঠিক সময়ে ঘুমাতে হবে।
. চাপমুক্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে।
. ধূমপান ও মদপান না করার উপর জোর দিতে হবে।
. ৪০ বছর বয়সের পরে মাঝেমধ্যে প্রেশার মেপে দেখতে হবে।
চেম্বার : পার্কভিউ হাসপাতাল চট্টগ্রাম, রুম নং- ৩১৭ ফোন: ০১৭১৬-৩৮৪৪১৯
’
Discussion about this post