ডা. মারজোয়া হুমায়রা মেখলা
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি)। এটি একটি নন কমিউনিকেবল ডিজিজ অর্থাৎ এটি সংক্রমিত হয় না। সারাবিশ্বে প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। প্রতিনিয়তই বাড়ছে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। গোটা বিশ্বে যেখানে ১৪ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত, সেখানে বাংলাদেশের একটা মেটা এনালাইসিসে দেখা গেছে, প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত, শতাংশ হিসাবে যা অনেক বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে অন্তত দুই কোটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে আক্রান্ত। যাদের মধ্যে প্রতিবছর কিডনি অকেজো হয় অন্তত ৪০ হাজার মানুষের। তাই এই রোগকে প্রতিরোধ করতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।সিকেডি এর পাঁচটি ধাপ আছে। শেষ ধাপে চলে গেলে রোগীকে রেনাল রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নিতে হয়। যার অর্থ বিকল্প ব্যবস্থা। যেমন- হিমো ডায়ালাইসিস, সিএপিডি, কিডনি সংযোজন বা ট্রান্সপ্লান্ট।
হিমোডায়ালাইসিস (এইচডি) এর সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু সিএপিডি (কন্টিনিউয়াস অ্যাম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস), যা অত্যন্ত সহজ উপায়ে ঘরে বসে ২৪ ঘণ্টা ডায়ালাইসি নেওয়া যায়, সেটা এখনো এতটা পরিচিত বা জনপ্রিয় নয়। অনেকেই তা জানেন না। অথচ কিডনি অকেজো হয়ে গেছে এমন রোগীদের চিকিৎসায় এখন বিশ্বে সিএপিডি একটি ব্যাপক জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি।
সিএপিডি কী এবং কী করা হয়?
সিএপিডিতে একটা ছোট্ট অপারেশনের মাধ্যমে পেটের ভেতর একটি নল প্রবেশ করানো হয়। এর মাধ্যমে একটা বিশেষ ধরনের স্যালাইন পেটের ভেতরে দেওয়া হয়। চার থেকে আট ঘণ্টা থাকে এবং তারপর বের করে দেওয়া হয়। বের হয়ে যাওয়া স্যালাইন এর সঙ্গে রক্তের বর্জ্যগুলোও বের হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় পেটের অভ্যন্তরের পেরিটোনিয়াল মেমব্রেন ছাঁকনির কাজ করে। এভাবে ফ্লুইড পেটের ভেতরে কিছু সময় রাখলে রক্ত থেকে দূষিত পদার্থ শুষে নেয়। সিএপিডি রক্তের ডায়ালাইসিস এর মত এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অত্যন্ত সহজ উপায়ে ঘরে বসে ২৪ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস নেয়া যায়। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১২৮জন সিএপিডি নিয়েছে। তার মধ্যে ৬২ জন নারী এবং ৬৬ জন পুরুষ। নারী এবং পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। তবে নারী রোগীরা নারী চিকিৎসকের কাছে সিএপিডি করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু বর্তমানে দেশে নারী চিকিৎসকের সংকট প্রকট। এখানে ডায়ালাইসিস মেশিনের বা কিডনির ছাঁকনি প্রক্রিয়ার কাজটি করে রোগীর নিজের পেটের পর্দা।
মূল প্রতিবন্ধকতা
সিএপিডির প্রথম প্রতিবন্ধকতা হলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক সংকট। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের অভাবে যথাযথ চিকিৎসা হয়ে ওঠে না। বাংলাদেশে হাতেগুণা কয়েকজন চিকিৎসক সিএপিডিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তার মধ্যে আমি একমাত্র নারী চিকিৎসক হিসেবে এই অপারেশন করে যাচ্ছি।
দ্বিতীয়ত; স্যালাইনের মূল্য। একটি স্যালাইনের বর্তমানে মূল্য ৪৬০ থেকে ৫১০ টাকা। এক দিনে দুই থেকে তিনটা স্যালাইন প্রয়োজন হয়। এ হিসাবে মাসে খরচ হবে ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা। নিন্মবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটি অনেকটা কষ্টসাধ্য হয় পড়ে। কিন্তু এই খরচ সরকার বহন করলে অনেক রোগী প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও ঘরে বসেই ২৪ ঘণ্টা এই ডায়ালাইসিস নিতে পারবে। একই সময়ে অফিস বা ঘরের কাজও করতে পারবে। রোগীকে কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য হাসপাতালে যেতে হবে না। ভবিষ্যতে এই বিশেষ স্যালাইনটি আমাদের দেশেও তৈরি করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে কেবল বেক্সটার নামের একটি কোম্পানি এটি সরবরাহ করছে।
এছাড়াও এপিডি (অটোমেটে পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস) মেশিন, যা দিয়ে শুধু রাতে ডায়ালাইসিস নিয়ে আর সারাদিন নিতে হয় না। কিন্তু এ মেশিন এখনও আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। পার্শ্ববর্তী দেশ- ভারত, হংকং, মালয়েশিয়াতে এই চিকিৎসা অত্যন্ত জনপ্রিয়। এছাড়াও থাইল্যান্ড এবং মেক্সিকোতেও পিডি ফার্স্ট পলিসি অনুসরণ করা হয়। যার অর্থ হচ্ছে সিএপিডি দিয়ে আরআরটি শুরু করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ফ্লুইডটি সরকার রোগীদের দিয়ে থাকে। আমাদের সরকার ইতোমধ্যেই হিমোডায়ালাইসিস এর জন্য অনেক অর্থ বরাদ্দ করেছে। সিএপিডির জন্যও কিছু অর্থ বরাদ্দ করলে অনেক রোগী ঘরে বসেই এই সেবা নিতে পারবে। পাশাপাশি স্যালাইনটিও আমাদের দেশে তৈরি করলে প্রতিটি স্যালাইনের ব্যাগের দাম কমে যাবে। রোগীরাও উপকৃত হবেন।
সিএপিডি আধুনিক কিডনি চিকিৎসার কার্যকর পদ্ধতি। তাই এটি সম্পর্কে দরকার আরও বেশি প্রচারণা, মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে তোলা। একই সঙ্গে জরুরি চিকিৎসা ব্যয় কমাতে ফ্লুইডসহ আনুষঙ্গিক সামগ্রির দাম কমানো।
লেখক: কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ, কিডনি রোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post