হার্টবিট ডেস্ক
আগামী ২৮ আগস্ট দেশের প্রথম সেন্টার বেইসড সুপার স্পেশালাইজড হাসাপাতালের শুভ উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বিএসএমএমইউর অধীনে নির্মিত এ সুপার স্পেশালাইজড হাসাপাতাল উদ্বোধন করা হবে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৮ জুলাই) দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লক মিলনায়তনে পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এন্ড অনকোলজি বিভাগ ও মুভমেন্ট ফর থ্যালাসেমিয়া ইরাডিকেশন ইন বাংলাদেশ (এমটিইবি) যৌথভাবে আয়োজিত ‘থ্যালাসেমিয়া অ্যান ইমার্জিং ন্যাশনাল হেলথ ইস্যু: ওয়ে টু মিনিফাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর অর্জনের মতো স্বাস্থ্যখাতে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালও দেশের জন্য একটি বিরাট অর্জন।
অনুষ্ঠানে থ্যালাসেমিয়া গাইড বুক ও স্যুভেনির, ‘রক্তিম সাহারার আত্মকথা’ প্রকাশিত হয় এবং রোগীগণ তাদের করুন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রায় ১০ ভাগ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক। থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে বিয়ের আগে পাত্রপাত্রীর রক্ত পরীক্ষা করা জরুরি। থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসায় বোনমেরু ট্রান্সপ্লান্ট করার জন্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় বিএসএমএমইউকে সকল ধরণের সহযোগিতা করবে। ঘরে ঘরে থ্যালাসেমিয়া নির্মূলে সচেতনতা জাগ্রত হোক, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ আন্দোলন সফল হোক এই কামনা করি। তিনি তার বক্তব্যে তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সকল ধরণের সহযোগীতার আশ্বাস প্রদান করেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পুনবার্সন ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে প্রয়োজনে আইন করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সাফল্য তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, দেশের স্বাভাবিক সময়ের স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি দুর্যোগ পূর্ব, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পুনবার্সন ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে। চলমান কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম সারা বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভ্যাক্সিন হিরো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, থ্যালাসেমিয়া একটি রক্তরোগ। বিয়ের আগের পাত্রপাত্রীর রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা তা জানা সম্ভব। রক্তের সাথে সাথে চোখেরও পরীক্ষা করা উচিত। পাত্রপাত্রী যদি উভয়ই চোখের মাইনাস পাওয়ারের হয় তবে তাদের সন্তানের চোখেও মাইনাস পাওয়ারের হবে। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে ভর্তির সময় এবং বিয়ের সময় কাজী অফিসে বর-কনের রক্ত পরীক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।
পৃথিবীর কয়েকটি থ্যালাসেমিয়া মুক্ত দেশের কথা উল্লেখ করে বিএসএমএমইউ ভিসি বলেন, যে জাতি বিশ্বব্যাংকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রমত্ত পদ্মা নদীর উপর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারে সেই জাতি অবশ্যই থ্যালাসেমিয়া মুক্ত দেশ গড়তে পারবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে অবশ্যই থ্যালাসেমিয়া মুক্ত করতে পারব। তিনি তার বক্তব্যে সবাইকে মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানান।
সংসদ সদস্য ডা. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, জন্মের পরপরই নবজাতকের রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড,বি-ভাইরাসসহ বেশ কিছু রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। দেশে অটিস্টিক শিশুদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১০ বছর পরে কী অবস্থা দাঁড়ায় তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে রুটিন পরীক্ষার উপর জোর দিতে হবে এবং এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এন্ড অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও এমটিইবি’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. এটিএম আতিকুর রহমান জানান, থ্যালাসেমিয়া একটি বংশানুক্রমিক রোগ। দেশের জনগণের প্রায় ৬-১২ শতাংশ মানুষ বিভিন্ন ধরনের থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। এ ছাড়াও প্রতি বছর প্রায় সাত হাজার নতুন শিশু থ্যালাসেমিয়া রোগের জিনসহ জন্মগ্রহণ করে থাকেন। থ্যালাসেমিয়া রোগীরা সাধারণত দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী অন্যটি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। যারা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগী তাদেরকে প্রতি মাসেই ১-২ বার রক্ত দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় এবং তারা সারাজীবন এ রোগ বহন করে বেড়ান। এদের অনেকেই ২০-৩০ বছর বয়সের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন।
বোনম্যারো ট্রান্সপ্লানটেশন করে এদেরকে চিকিৎসা করা হলে এদের সুস্থ্য করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এই দেশে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লানটেশন জটিল ও ব্যয়বহুল এবং এটা অপ্রতুল। অন্যদিকে যারা থ্যালাসেমিয়ার বাহক তারা এই রোগ বহন করেন এবং আরেকজন বাহককে বিবাহ করলে তাদের সন্তানদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি কিন্তু একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক যদি একজন নরমাল ব্যক্তিকে (ক্যারিয়ার নয়) বিবাহ করেন তবে তাদের সন্তানদের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই। কাজেই সমাজের সর্বস্তরে এই রোগের ব্যাপকতা এবং একজন বাহক যাতে অন্য একজন বাহককে বিবাহ না করেন, একজন নরমাল ব্যক্তিকে বিবাহ করেন তা নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি আরো জানান, থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে জনসচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে MTEB (Movement for Thalassemia Eradication in Bangladesh) নামক সামাজিক আন্দোলন গঠন করা হয়। এই সংগঠন এবং শিশু হেমাটোলজি এন্ড অনকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে দেশের প্রায় ৪০ জন শিশু রক্ত রোগ ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ এবং শিশু বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে একটি সুষ্ঠু কর্মশালা সম্পন্ন করে। কর্মশালায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান সিদ্ধান্ত সমূহ হলো: দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও অন্যান্য কলেজে শিক্ষার্থীরা থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা তা জানার ব্যবস্থা করা এবং এই ব্যাপারে একজন নরমাল ব্যক্তি এবং থ্যালাসেমিয়া বাহকের বিবাহের ব্যাপারে উৎসাহমূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা। জাতীয়ভাবে থ্যালাসেমিয়া স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম এবং
MIP Couple এর সম্পর্কে জনমত সৃষ্টির জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক একটি উদ্বোধনমূলক অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থ করা। থ্যালাসেমিয়ার বাহক নির্ণয় ও থ্যালাসেমিয়া নির্মূলের ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগে একটি থ্যালাসেমিয়া Disease Control & Prevention Program গ্রহণ করা। থ্যালাসেমিয়া বাহকগণ যাতে কিছুতেই অন্য একজন থ্যালাসেমিয়া বাহককে বিবাহ করতে না পারেন। এ ব্যাপারে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশে শিশু রক্তরোগ ও ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসার প্রয়োজনে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আহবান জানানো হয়। চলতি বছরের ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল শিশু দিবসটি প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ক্যান্সার সাইভার শিশুদের নিয়ে আয়োজন করার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা ।
অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব ড. মো. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার, বিএসএমএমইউর প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদ হোসেন, সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা, ডব্লিউএইচও, ইউনিসেফ ও সেভ দ্যা চিলড্রেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিগণ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক ডা. চৌধুরী ইয়াকুব জামাল। থ্যালাসেমিয়া বিষয়ে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পেশ করেন সহকারী অধ্যাপক ডা. মোমেনা বেগম। অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও চিকিৎসকবৃন্দ, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু ও তাদের সম্মানিত অভিভাবকগণ উপস্থিত ছিলেন।
Discussion about this post