ডা. অপূর্ব চৌধুরী
মুখের নতুন একটি রোগ শনাক্ত করেছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। এর নাম Ramsay hunt syndrome। এটিকে মুখের প্যারালাইসিসিও বলা হয়। বহু মানুষ সম্প্রতি এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
কানাডার তরুণ কণ্ঠশিল্পী জাস্টিন বিবারের মুখের এক অংশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। এ সময় তার একটি বিশ্বব্যাপী কনসার্ট ট্যুর প্লান ছিল। অকস্মাৎ এ সমস্যাটি তাকে সেই কনসার্ট থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করল এবং সেই সঙ্গে তার লাখ লাখ ভক্তদের জানাতে বাধ্য হলো যে, তার এমন একটি বিরল রোগ হয়েছে যেটির কারণে তিনি এ মুহূর্তে গান গাইতে পারছেন না। সমস্যাটি তার কণ্ঠে নয়, সমস্যা ঠিক তার মুখে এবং বিশেষ করে মুখমণ্ডলের একপাশে।
রোগটির নাম রামজি হান্ট সিনড্রম। বলা হয় প্রতি এক লাখ আমেরিকানদের মধ্যে বছরে ৫ জনের এ সমস্যাটা দেখা দেয় প্রতিবছর। এক অর্থে এটি খুব বিরল সমস্যা। বিশ্বব্যাপী সমস্যাটির তেমন একটা স্ট্যাটিসটিক্স বা তথ্য নেই। এর কারণ হলো এ সমস্যাটি অন্য আরেকটি সমস্যার মতো দেখতে বলে অনেকের এ সমস্যাটি হলেও আগে থেকে না জানার কারণে সেটিকে অন্য আরেকটি সমস্যা ধরা হয় বেশি। bell’s পালসি নামে আরেকটি সমস্যা অনেকটাই রামজি হান্ট সিনড্রমের মতো।
রামজি হান্ট সিনড্রম সমস্যাটি হয় একটি ভাইরাসের কারণে। ভাইরাসটি মুখের অংশে যে নার্ভ থাকে তাকে আক্রমণ করলে সমস্যাটি দেখা দেয়। নিউরোলজিক্যাল এ সমস্যাটির কারণে মুখের যে কোনো অংশ প্যারালাইজড হতে পারে। কারণ ভাইরাসের আক্রমণের ফলে মুখের নার্ভ প্যারালাইজড হয়ে যায়। মুখের প্যারালাইজডের সঙ্গে সঙ্গে মুখে অথবা কানে কিছু প্রদাহ দেখা দেয় সঙ্গে যা বেশ পেইনফুল হতে পারে। অনেক সময় মুখে যেমন আক্রমণ করে তেমনি কানেও, আক্রমণ করে, ফলে রামজি সিনড্রম হলে অনেকের কানে কম শোনার সমস্যাও দেখা দিতে পারে। কোনো কোনো পেশেন্ট দেখা গেছে কানে কোনো একটি আওয়াজ শোনার সমস্যা বেড়ে যায় এতে এবং সমস্যাটি টিনিটাস নামে পরিচিত।
রামজি হান্ট সিনড্রম যা সংক্ষেপে RHS নামে পরিচিত। এটি হওয়ার কারণ হিসাবে যে ভাইরাসটি চিহ্নিত করা হয়েছে সেটি হলো ভেরিসেলা জোস্টার ভাইরাস।
অন্য আরও কিছু সমস্যার সঙ্গে তার মিল থাকলেও রামজি হান্ট সিনড্রম বলতে হলে দুটি সমস্যা থাকতে হয়। পেরিফেরাল ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস, কানে অথবা মুখে ইরাইথিমেটোসাস ভাস্কুলার রেশ। শুধু ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস হলে তাকে রামজি হান্ট সিনড্রম বলা যাবে না। এ দুটি প্রধান সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা রামজি হান্ট সিনড্রম দেখা দেয় যা ব্যক্তি ভেদে পার্থক্য হয়। যেমন : টিনিটাস, হেয়ারিং লস, মাথা ঘোরা, বমির ভাব হওয়া অথবা বমি আসে, ন্যাস্টিগমাস, এমন সব সমস্যা। অন্যদিকে বেলস পালসি এ সমস্যাটির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি রামজি হান্ট সিনড্রমকে লোকে মিলিয়ে ফেলে। রামজি হান্ট সিনড্রম মুখে অথবা কানে প্রদাহ দেখা দেয়, কিন্তু bell’s পালসি একইভাবে অষ্টম ক্রেনিয়াল নার্ভ ফেসিয়াল নার্ভের প্যারালাইসিসের কারণে হয়, রোগী মুখে অথবা কানে কোনো ধরনের রেশ প্রদাহের দেখা দেয় না।
এটি হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সচরাচর বেশিরভাগ রোগী আক্রান্ত সমস্যাটি থেকে কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে সময়টি দীর্ঘতর হয় সুস্থ হয়ে উঠতে। ট্রিটমেন্ট এর মধ্যে প্রেডনিসোলন এবং এন্টিভাইরাল মেডিসিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমস্যাটি মুখে এবং কানে হয় বলে অনেক সময় মেডিকেল প্রফেশনের লোকেরা সমস্যাটিকে হারপিস জোস্টার অটিকার্স নামে বলে থাকে।
ছোটবেলায় আমাদের কমবেশি অনেকের একটা রোগ হয়-চিকেন পক্স। আবার বড়বেলায় আরেকটি চিকেন পক্সের মতো সমস্যা দেখা দেয় যার নাম সিঙ্গেল। চিকেন পক্স এবং সিঙ্গেল দুটিই একটি নির্দিষ্ট ভাইরাসের কারণে হয়। নাম : ভেরিসেলা জোস্টার ভাইরাস। যাদের চিকেন পক্স অথবা সিঙ্গেল হয়েছে শুধু তাদের ক্ষেত্রে রামজি হান্ট সিনড্রম হতে পারে। চিকেন পক্স অথবা সিঙ্গেল হলে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকে আক্রান্ত করার পর ভালো হয়ে গেলেও পরে কিছু ভাইরাস শরীরে থেকে যায়। পরে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনো কারণে সাময়িক দুর্বল হয়ে গেলে অথবা শরীর কোনোভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাজাতীয় কোনো সমস্যায় ভুগলে এই থেকে যাওয়া ভেরিজসেলা জস্টার ভাইরাস যে কোনো সময় আবার অ্যাক্টিভ হয়ে উঠতে পারে। তখন তারা সচরাচর প্রথমে কানে এবং পরে মুখের প্রধান নাম ফেসিয়াল নার্ভকে আক্রান্ত করে। আর এতে কান এবং মুখ দুই আক্রান্ত হয়ে রামজি হান্ট সিনড্রম হিসাবে প্রকাশ পায়। শরীরের ইমিউনিটি কমে যাওয়ার ছাড়াও কোন কারণে এক্স-রে অথবা আলট্রা ভায়োলেট রে অথবা শরীরে কোনো বিষাক্ত পদার্থ ঢুকলে অথবা কোনো অজানা কারণে এ ভাইরাসটি অ্যাক্টিভ হয়ে উঠতে পারে।
এটি কখনো একজন থেকে আরেক জনের হয় না। এটি হলে অবশ্যই প্রথমে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন। ফেসিয়াল নার্ভ আক্রান্ত করা অন্য সমস্যাগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন রামজি কনফার্ম হয়েছে কিনা অথবা অন্য কোনো সমস্যা হলো কিনা দুটির মধ্যে পার্থক্য করবেন শুরুতে। সিদ্ধান্তে আসার পর তিনি এন্টি ভাইরাস ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করবেন এবং পরে স্পিসজনিত কোনো সমস্যা থেকে গেলে স্পিচ থেরাপিস্ট মাধ্যমে মুখের বিভিন্ন পেশিকে সচল করার মধ্য দিয়ে সমস্যাটি থেকে বেরিয়ে আসবে। এর বাইরে ঘরে কিছু চিকিৎসা নিজে নিজে নিতে পারেন।
মুখের যে অংশে ব্যথা করবে এবং কানে যদি ব্যথা করে তাহলে সেই অংশের কাছাকাছি জায়গায় ঠান্ডা কোনো টাওয়েল ধরে রাখলে ব্যথা কম লাগবে।
এ সময় কোনো ধরনের ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি কমিয়ে যতটুকু পারেন ঘুমাবেন এবং রেস্ট নেবেন, যা আপনার নার্ভ দ্রুত ঠিক হতে সাহায্য করবে।
মুখে বা কানে বেশি ব্যথা করলে ব্যথাজাতীয় ওষুধ খেতে পারেন অথবা লোকাল এনেস্থেটিকজাতীয় ক্রিম অথবা পাউডার মুখের সে অংশের লাগালে ব্যথা কম অনুভব করবেন।
Discussion about this post