ডা. নুসরাত সুলতানা লিমা
গত বছর থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সংগঠন We are not alone (WANA) এর আমন্ত্রণে বিশেষ অতিথি হিসেবে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমি বেশ আগে ভেন্যুতে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল একজন কিশোর। ছেলেটি সদালাপী, ভীষণ উচ্ছল ও হাসিখুশি। কথা বলে মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন আগ থেকেই আমরা পরস্পরকে চিনি।
আমাকে না জিজ্ঞাসা করেই এক কাপ কফি আমার জন্য নিয়ে এল। কফি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবু, তুমি কোন ক্লাসে পড়?’ ছেলেটির হাসি আরো বিস্তৃত হলো। আয়োজক কামরুন আপা বললেন, ‘আপা ও বিবিএ থার্ড ইয়ারে পড়ে।’ আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। তবে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ও বহুদিন ধরে এসব শোনায় অভ্যস্ত।
বহু থ্যালাসেমিয়া রোগী নিয়ে কাজ করেছি। জানতাম, যে থ্যালাসেমিয়ার একটি জটিলতার নাম Gonadal Failure অর্থাৎ এরা কখনও যৌবনপ্রাপ্ত হয় না। সবার এই জটিলতা হয় না। কেবলমাত্র যারা নিয়মিত ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা পায় না, তাদের হয়। ছেলেটির এই জটিলতা থাকায় দেখতে কিশোর লাগছিল।
থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়মিত ঘনঘন রক্ত দেওয়ার ফলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেমন: লিভার, হার্ট ও কিডনি ছাড়াও হরমোন নিঃসরণকারী গ্রন্থিতে আয়রন বা লৌহ জমা হয়ে অঙ্গগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। ফলে এরা হার্ট, কিডনি, লিভারের জটিল রোগের সাথে সাথে বিভিন্ন হরমোনের সমস্যায় ভোগে। তাই থ্যালাসেমিয়া রোগীদের রক্তের পাশাপাশি আয়রন নিষ্কাশনের ওষুধ দিতে হয়, যা বেশ ব্যয়বহুল। নিয়মিত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে এই ওষুধ না খেলে থ্যালাসেমিয়া রোগীরা খুব দ্রুত নানা ধরনের জটিলতার মুখোমুখি হয় ও খুব কম বয়সে মারা যায়।
এবার ছেলেটির প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। ছেলেটির বয়স ২৩ বছর। ওর বাবা নেই। সংসারের খরচ চালানোর জন্য অসুস্থ শরীরে বিবিএ পড়ার পাশাপাশি সে একটি চাকরিও করতো। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও জড়িত ছিল। আমি যে প্রোগ্রামে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম, সেটি সঞ্চালনা করেছিল ছেলেটি। ভীষণ সম্ভাবনাময়, প্রাণোচ্ছল, মেধাবী আর স্বপ্নবাজ ছিল ছেলেটি।
গত মাসে হঠাৎ করে ছেলেটি তার কর্মস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকে কিছুদিন। তারপর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যায়। এই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণ হার্ট ফেইলিউর।
জন্মগত রক্তরোগ থ্যালাসেমিয়া নিয়ে প্রতিবছর জন্মগ্রহণ করে ৯০০০-১০০০০ শিশু। এদেরকে সারাজীবন অন্যের রক্তের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হয়। চিকিৎসা না পেলে এরা ১০ বছর বয়স পূর্ণ করার আগেই মারা যায়। আর পর্যাপ্ত চিকিৎসা পেলে বেঁচে থাকতে পারে বহুদিন। তবে চিকিৎসা ব্যয়বহুল এবং প্রতি মাসে রক্ত জোগাড় করা কঠিন বলে বেশিরভাগ রোগী নিয়মিত ও পর্যাপ্ত চিকিৎসা নিতে সক্ষম হয় না।
ফলে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, রোগী যত বাড়বে রক্তের চাহিদা তত বাড়বে, কিন্তু রক্তদাতা তো সেই হারে বাড়বে না।
থ্যালাসেমিয়া রোগ প্রতিরোধ করা তেমন কঠিন নয়। শুধুমাত্র বাহকের সঙ্গে বাহকের বিয়ে বন্ধ করলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ সম্ভব।
কিভাবে বুঝবেন আপনি বাহক? রক্তের একটি পরীক্ষা হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস করেই বুঝবেন আপনি বাহক কি না।
Discussion about this post