ড. শাফিউন নাহিন শিমুল
করোনার ধকল আপাতত সামলে উঠলেও শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা বিশেষ করে মেগা প্রজেক্টে অতিরিক্ত ব্যয় ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে এবারের বাজেট অন্যবারের চেয়ে বেশি মনোযোগ পাবে।
তাছাড়া অর্থনীতির অন্যান্য খাতকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাত তাই এইবারও উপেক্ষিত থাকা ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু বস্তুত বিভিন্ন কারণে এবার স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার।
যদিও বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের পলিসি পরিবর্তন করার মতো তেমন কিছু থাকে না, তবে এইবারের বাজেট স্বাস্থ্যখাতের কিছু আশু চ্যালেঞ্জ ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যাগুলো মাথার রেখেই করা উচিত। অন্ততপক্ষে কিছু কার্যকর পদক্ষেপের ইঙ্গিত থাকা বাঞ্ছনীয়।
সরকারিভাবে মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে দেখালেও বাস্তবে যে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি অতিমাত্রায় বেশি হচ্ছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনেক বেশি বেড়ে গেলে সাধারণত নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারেই বেশি সমস্যা হয়ে থাকে কারণ তারা তাদের আয়ের বেশিরভাগ এই খাতে ব্যয় করে থাকে।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলে যেহেতু বাজেটের বেশিরভাগ অংশই সংসার চালাতে বেশি খরচ হবে, তাই সেসব খরচ পরে করলেও হয় বা পরে করা যায় বলে মনে করা হয়, ঐ ধরনের খাতে কম ব্যয় করা হবে। কাজেই স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া বিলম্বিত হওয়া সম্ভাবনা রয়েছে। যা পরবর্তীতে স্বাস্থ্যের অবস্থার অবনতি ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশে যেহেতু বেসরকারি খাত থেকে বেশি স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া হয় এবং ওষুধের পেছনে বেশি খরচ হয়। কিন্তু এটা ধরে নেওয়া যায় যে, সরকারি খাতে ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে অনেকেই সরকারি হাসপাতালমুখী হবে।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের পলিসি পরিবর্তন করার মতো তেমন কিছু থাকে না, তবে এইবারের বাজেট স্বাস্থ্যখাতের কিছু আশু চ্যালেঞ্জ ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যাগুলো মাথার রেখেই করা উচিত।
অন্ততপক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষ সরকারি হাসপাতালমুখী হবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপে ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃত আয়ে (টাকার ক্রয়ক্ষমতাকে হিসেবে আয়ের হিসাব) কমে যাওয়ার আরও বাড়তি চাপ যাতে না বাড়ে অন্ততপক্ষে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত ব্যয়ে সেই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে।
গত কয়েক বছরের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, বাজেট বরাদ্দের কিছু অংশ ব্যয় না হলেও ওষুধের পেছনে মোটামুটি ভালোই খরচ হয়। এতে অনুমান করা যায় যে, এই খাতে আরও অর্থ সংস্থানের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ লোক দরিদ্র হয়। সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের অনেক কার্যক্রম নিলেও স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়জনিত দরিদ্র হওয়া ঠেকানোয় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সমাজের অতিদরিদ্রের জন্য কম্বোডিয়ার মতো হেলথ ইক্যুইটি ফান্ড যা দেশের দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে চালু করা যেতে পারে। যদিও সরকারের কিছু এই ধরনের কিছু কার্যক্রম আছে, কিন্তু বেশিরভাগ গবেষণা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, তা অপ্রতুল বা কার্যকর নয়।
জনশ্রুতি আছে যে, যেসকল খাতে দুর্নীতি করার সুযোগ বেশি থাকে বা উপরমহলকে তুষ্ট করার সুযোগ থাকে যেমন যন্ত্রপাতি ও যানবাহন ক্রয় ইত্যাদি খাতে বাজেটের প্রায় শতভাগ ব্যয় হয়ে থাকে।
অর্থনীতির চাপে থাকার সময়ে এই ধরনের অপচয়ের লাগাম টানতে হবে। তাছাড়া সরকারি ব্যয়ে প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশগ্রহণের নামে প্রমোদভ্রমণ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা উচিত। তবে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রয়োজনীয় খাতে বরাদ্দ যেন কম না হয়।
আগে উল্লেখ করেছি যে, মানুষ সাধারণত বেসরকারি চ্যানেল থেকে বেশি সেবা নিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির আগে থেকেই বেসরকারি খাতে সেবার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির অজুহাত দেখিয়ে এই ধরনের সেবারও মূল্য যাতে অযৌক্তিক পর্যায়ে না যায় সেদিকে খেলায় রাখতে হবে।
এটা ধরে নেওয়া যায় যে, সরকারি খাতে ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে অনেকেই সরকারি হাসপাতালমুখী হবে।
একই অজুহাতে যেন ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করতে না পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় ওষুধ তৈরির কাঁচামালের ব্যয় বাড়ার কারণে উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। তবে সয়াবিন তেল ব্যবসায়ীদের মতো অশুভ চক্র যাতে গড়ে না উঠে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
দেশ উন্নত হলে স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। একই সাথে তার ব্যয়ও বাড়তে থাকে। কোনো প্রি-পেমেন্ট (যেমন ইনস্যুরেন্স) ব্যবস্থা না থাকলে উন্নত দেশের মানুষের পক্ষেও বিশেষ করে বড় কোনো অসুস্থতা হলে স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় বহন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। বাংলাদেশে এই ধরনের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এদিকে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।
প্রশ্ন উঠতে পারে, অর্থনীতির চাপের মধ্যে থাকা সরকার কীভাবে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়াতে পারে বা নতুন অর্থের সংস্থান করতে পারে। এক্ষেত্রে তামাক ও তামাকজাত পণ্যে বেশি করে করারোপ করা যেতে পারে।
কেউ হয়তো মনে করতে পারেন এতে তামাক ব্যবহার অনেক কমে গেলে সরকারের আয় না বেড়ে কমতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সাম্প্রতিক গবেষণা তা বলে না।
গবেষণায় আমরা দেখেছি যে, তামাকের ক্ষেত্রে ইলাস্টিসিটি (অর্থাৎ দাম বাড়লে মানুষ কতটুকু ব্যবহার কমায়) তা খুবই কম। এর অর্থ হলো, তামাক পণ্যের দাম অনেক বাড়ালে সামান্য ব্যবহার কমলেও সরকারের আয় অনেক বৃদ্ধি পাবে এবং আমরা দেখেছি যে তাতে সরকারের পাঁচ থেকে দশ হাজার কোটি টাকা বেশি আয় হতে পারে। অন্যদিকে তামাক ব্যবহার কমার কারণে জনস্বাস্থ্যের উপরও ভালো প্রভাব থাকবে।
তাই আমাদের প্রত্যাশা শুধু বেশি বরাদ্দই নয়, একটি সুন্দর ও সুস্থ স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি করতে প্রয়োজনীয় রূপরেখাও যেন আগামী বাজেটে থাকে।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল ।। সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিডিসি ফাউন্ডেশন ফেলো, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
Discussion about this post