অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান
আজ ৩০ এপ্রিল (শনিবার) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ২৪টি বছর পূর্ণ করে ২৫তম বছরে পদার্পণ করেছে। ইতোমধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় সেন্টার অফ এক্সিলেন্স হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। দেশ-বিদেশে চিকিৎসা চিকিৎসা সেবা ও গবেষণায় বিএসএমএমইউ বর্তমানে এক অনন্য নাম। উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষাতেও রয়েছে বিরাট অবদান। আমি আমার লেখার শুরুতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমার চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসটি এমন এক সময়ে উদযাপিত হচ্ছে যখন কোভিড ১৯ বিশ্ব মহামারীর তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলা করে মানুষ স্বাভাবিক জীবনে সবেমাত্র পদাচারণা শুরু করেছে। তবে পবিত্র মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে এ বছর বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করাসহ সকাল ৯টায় বি ব্লকের সামনে বটতলা থেকে র্যালি বের হবে। বিশ্ববিদ্যায় দিবস ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কর্মসূচি, অনুষ্ঠান যা-ই পালন করা হোক না কেন সেটা বড় কথা নয়, সব চাইতে বড় কথা হলো উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষায়, উন্নত চিকিৎসাসেবা প্রদানে ও নিত্য নতুন গবেষণায় এই বিশ্ববিদ্যালয় কতটা অবদান রাখতে পারছে সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
সূচনা লগ্নের কথা, আইপিজিএমএন্ডআর ও বিএসএমএমইউ প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে গবেষণার জন্য স্বাধীনতা পূর্ব ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআরকে গবেষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন এবং এই হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০ বেডে উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দূরবস্থার মধ্যেও চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুষ্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্নাতকোত্তর শিক্ষার ক্ষেত্রে আইপিজিএমএন্ডআরকে (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শাহবাগে স্থানান্তর করা হয়, তখন শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০০। বঙ্গবন্ধু শয্যা সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআরে কেন্দ্রীয় রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের উদ্বোধন করেন।
১৯৯৬ সালে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা বর্তমানে বিশ্ব নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিয়ে এককভাবে সরকার গঠন করার মাত্র দু’বছরের মধ্যে ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দেশের প্রথম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’।
প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক সদিচ্ছাতেই পূরণ হয়েছে, এদেশের চিকিৎসক সমাজের তিন দশকের দাবি। ১৯৯৮ সালে দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছেন। বাস্তবেই বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসাসেবার আশা-ভরসা ও আস্থার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিএসএমএমইউ আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা উপ-মহাদেশের সবচাইতে বড় হাসপাতাল ও চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিএসএমএমইউ আজ এদেশের চিকিৎসাসেবা ও গবেষণায় সাফল্যের ক্ষেত্রে এক অনন্য নাম।
চিকিৎসা শিক্ষা:
তৎকালীন আইপিজিএমএন্ডআরের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭টি কোর্স দিয়ে। বর্তমানে বিএসএমএমইউতে এমডি, এমএস, এমপিএইচ, এমফিল, ডিপ্লোমাসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট বিষয়ের সংখ্যা প্রায় শতক পূর্ণ করেছে। রেসিডেন্সি কোর্সের সংখ্যাও ষাটের বেশি। অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজ ও ইন্সটিটিউটের সংখ্যা ৫৩টি। অনুষদের সংখ্যা ৭টি। বিভাগের সংখ্যা ৫৬টি। রয়েছে ইনস্টিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক নিউরোডিসঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে ৮ শতাধিক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছন এবং প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। দেশের শিক্ষার্থী ছাড়াও নেপাল, ভারত, সোমালিয়া, ইরান, কানাডা, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া ও ভূটানসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীগণ লেখাপড়া করছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।
করোনাসহ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা:
বর্তমানে বিএসএমএমইউ গবেষণা দিবস উদযাপিত হচ্ছে। প্রতি বছর শিক্ষক, শিক্ষার্থীকে গবেষণা মঞ্জুরি প্রদান করা হচ্ছে। গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ইম্পিরিয়াল কলেজ অব লন্ডন, ভারতের মুম্বাইয়ের টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার, সুইজারল্যান্ডের জুরিখ ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড হসপিস এন্ড প্যালিয়েটিভ কেয়ার অ্যালায়েন্স, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রকফেলার ফাউন্ডেশন, জাপানের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, দেশীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টে নির্ধারণে ও টিকার কার্যকারিতা নিশ্চিত হতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এ বিষয়ে একাধিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিড-১৯ এর যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের ৯৮ শতাংশের শরীরে এন্টিবডির উপস্থিতি রয়েছে।
গবেষণায় কখনো ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, আবার কখনো সাউথ আফ্রিকান অমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রধান্য দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, বিএসএমএমইউয়ের বক্ষব্যাধি (রেসপিরেটরি) বিভাগের উদ্যোগে ৫০০ শত রোগীর উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তিন মাস পরেও ৪০ শতাংশ রোগীরা নানা ধরণের জটিলতায় ভুগছেন। জটিলতার মধ্যে রয়েছে কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, নাকে গন্ধ কম পাওয়া, নাক দিয়ে পানি পরা ইত্যাদি। বয়স্কদের মধ্যে এই সমস্যা সবচাইতে বেশি। ৫০০ রোগীর মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২ শতাংশ মহিলা। গবেষণায় পোস্ট কোভিড রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকার উপর গুরুত্বারো করা হয়। এছাড়া খাদ্যে ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি (ফুড হ্যাজার্ড) নিয়ে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এছাড়াও পুষ্টিসহ ৩টি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিএসএমএমইউ উদ্যোগে বিশ্বমানের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। বর্তমানে গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাট উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে তাদের এই উৎসাহের প্রধান কারণে হচ্ছে গবেষণা কার্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বিক সহায়তা, প্রয়োজনীয় নির্দেশনাদান ও উৎসাহব্যঞ্জক ভাষণ প্রদান অব্যাহত রাখা।
করোনায় অনান্য চিকিৎসাসেবামূলক কার্যক্রম:
মহামারী ও সঙ্কট মোকাবেলায় বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে অনুসরণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে দেশ আজ করোনা মহামারী থেকে অনেকটাই মুক্ত। শনাক্তের হার অর্ধ শতাংশেরও কম। কোনো কোনো দিন মৃত্যু শূন্য থাকছে। করোনা মোকাবিলায় বিএসএমএমইউর রয়েছে বিরাট অবদান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবায় বেতার ভবনে ফিভার ক্লিনিক ও করোনা ইউনিট চালু, কেবিন ব্লকে করোনা সেন্টার চালু, কনভেশন সেন্টারে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিল্ড হাসপাতাল চালু, ভাইরাসটি শনাক্তকরণে বেতার ভবনে পিসিআর ল্যাব চালু, কেবিন ব্লকে র্যাপিড টেস্টের ব্যবস্থা, কনভেশন সেন্টার ও ডক্টরস ডরমেটরিতে দেশের সর্ববৃহৎ কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্র চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে কোভিড ১৯ মোকাবিলায় বিরাট ভূমিকা রেখেছে। সাথে সাথে নন-কোভিড রোগীদেরও চিকিৎসাসেবা প্রদানে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে বিএসএমএমইউ দেশে চিকিৎসাসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। এজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স, টেকনোলজিস্ট, টেকনিশিয়ান, কর্মচারীসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করেছেন। এজন্য ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে আমি তাদেরকে বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সাফল্য ও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম এবং আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ:
বিএসএমএমইউর সাফল্য ও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে সাধারণ জরুরি বিভাগ চালু, নন-কোভিড রোগীদের জন্য সি ব্লকে আইসিইউ ইউনিট চালু, বন্ধ থাকা টিএসসি পুনরায় চালু, ২০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন অক্সিজেন প্ল্যান্ট উদ্বোধন, হেলথ কার্ড চালু, রোগীদের সুবিধার্থে বৈকালিক স্পেশালাইজড আউটডোর পুনরায় চালু, ৭ শতাধিক নন রেসিডেন্ট ছাত্র-ছাত্রীদের (চিকিৎসকদের) বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা, অস্থায়ী কর্মচারীদের চাকুরী স্থায়ীকরণ, পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু, ফরেনসিক মেডিসিন ও টক্সিকোলজি বিভাগ চালুসহ চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন ক্লিনিক, ইউনিট চালু এবং সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ ও চালুর কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন করে আনা ইত্যাদি। তবে চ্যালেঞ্জও রয়েছে তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও গবেষণাকে গতিশীল করতে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস কার্যক্রম চালু করা, বেতার ভবনে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল-২ নির্মাণ বাস্তবায়ন করা, আবাসিক সমস্যার সমাধানের করা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলতে চাই যে, দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয় ও অনস্বীকার্য। বর্তমান বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে ও উন্নত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে সকল বাধা পেরিয়ে দেশকে অগ্রগতি ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। বিএসএমএমইউকে চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্বমানে উন্নীত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মেনে এখানে কর্মরত সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবো এই হোক ২৫তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক-চেয়ারম্যান, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ; কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post