ডা. রিফাত আল মাজিদ
তীব্র গরম ও আবহাওয়াজনিত কারণে এ সময়ে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এছাড়াও পানি দূষণ ও ফুড পয়জনিংও অন্যতম কারণ ডায়রিয়ার রোগী বেড়ে যাওয়ার। দিনে তিনবারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে সেটাকে ডায়রিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও মিনারেল জাতীয় পদার্থ বের হয়ে যায়। যার ফলে দুর্বলতা ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো পানিস্বল্পতা পূরণ না করলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। শিশুরা ডায়রিয়ার সব বড় ভিকটিম বলা যায়। প্রতি বছর বাংলাদেশে শিশুর ডায়রিয়ার আক্রান্তের হার বাড়ছে। এবং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে শিশুর জন্য এটি খুবই ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করতে পারে।
সাধারণত অন্ত্রে বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ফলে ডায়রিয়া হয়। ডায়রিয়ার জীবাণু দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে মানুষের পেটে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির মল থেকে ডায়রিয়ার জীবাণুগুলো হাতের মাধ্যমে, মাছি বা তেলাপোকার মাধ্যমে, এমনকি অনেক সময় সরাসরি খাদ্য ও পানিতে সংক্রমিত হয়। এই দূষিত খাদ্য বা পানি গ্রহণ করলে অন্যরাও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়ে থাকে।
বিশেষত গরমের মৌসুম এপ্রিল ও মে মাসে ডায়রিয়ার প্রকোপ থাকে বেশি। কিন্তু এ বছর চিত্রটি একটু ভিন্ন। মৌসুমের শুরু থেকেই উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগী। হাসপাতালগুলোতেও জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্ক সবাই এর ভুক্তভোগী ছিলেন। করোনাকালীন মানুষ ঘনঘন হাত ধোয়ার মতো ভালো অভ্যাসে যেমন যুক্ত ছিলেন তেমনি আউটিং না হওয়াতে বাইরের খাবার থেকেও ছিলেন দূরে। হঠাৎ করে মানুষ এ অভ্যাস ছেড়ে দেওয়া ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরগুলোর পানির উৎসগুলোর পানির কারণেও ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। তবে ডায়রিয়া হলে উদ্বিগ্ন ও আতংকিত না হয়ে প্রয়োজন সচেতনতা।
সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে ডায়রিয়া বড় কোনও সমস্যা নয়।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে যা করবেন
১. এক প্যাকেট খাবার স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। শিশুর জন্য বার বার পাতলা পায়খানার হওয়ার সাথে সাথে ওরস্যালাইন দিতে হবে। বাজারে রাইস স্যালাইন পাওয়া যায় সেটাও দেওয়া যেতে পারে।
২. বড়দের (দশ বছরের বেশি) ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর এক গ্লাস (২৫০গ্রাম) পানিতে গুলিয়ে খাবেন।
৩. শিশুদের ডায়রিয়া হলে প্রতিবার পায়খানার পর শিশুর যত কেজি ওজন তত চা চামচ বা যতটুকু পায়খানা হয়েছে আনুমানিক ততটুকু স্যালাইন খাওয়াবেন।
৪. শিশুর বমি হলে ধীরে ধীরে খাওয়ান। যেমন প্রতি তিন-চার মিনিট পর পর এক চা চামচ করে স্যালাইন খাইয়ে দিন।
৫. খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর পাশাপাশি দুই বছরের নিচের শিশুকে অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, কোনোভাবেই বুকের দুধ খাওয়ানো বন্ধ করা যাবে না।
৬. ছয় মাসের অধিক বয়সী রোগী খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি সব ধরনের খাবার খেতে পারবে।
৭. প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে খাবার স্যালাইনের পাশাপাশি বেশি বেশি তরল খাবার যেমন ডাবের পানি, চিড়ার পানি, স্যুপ ইত্যাদি খাওয়াবেন।
৮. বাচ্চাদের ডায়রিয়া হলে কোমল পানীয়, ফলের রস, আঙুর, বেদানা খাওয়াবেন না।
৯. ছয় মাস থেকে পাঁচ বছরের শিশুকে প্রতিদিন একটি করে জিংক ট্যাবলেট পানিতে গুলিয়ে দশ দিন খাওয়াবেন।
১০. অবস্থার কোনও পরিবর্তন না হলে বা অবনতি হলে নিকটস্থ হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করাবেন।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে করণীয়
১. মলত্যাগে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করুন।
২. পায়খানা করার পর ও খাওয়ার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে নিন।
৩. খাবার তৈরি করা ও পরিবেশন করার আগেও হাত ধুয়ে নিন। ব্যবহার্য থালা-বাসন, চামচ-বাটি ইত্যাদিও ভালো করে ধুয়ে নিন। এসব কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার করুন।
৪. ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ান।
৫.বাসি-পচা খাবার, মাছি বসা খাবার এবং বাইরের খোলা খাবার, শরবত বা ফলের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
৬. রান্না করা খাবার বেশিক্ষণ বাইরে রেখে দিলে তাতে রোগজীবাণু দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সুতরাং খাবার খেয়ে নিন গরম গরম। বাড়তি খাবার ঠান্ডা করে রেখে দিন ফ্রিজে। পরে খাওয়ার সময় আবার ভালো করে গরম করে নেবেন।
৭. পরিষ্কার পাত্রে রাখা টিউবওয়েলের নিরাপদ পানি কিংবা ফোটানো পানি ঠান্ডা করে পান করুন। পানি ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হলে চুলায় পানি ফুটতে শুরু করার পর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত সময় ফোটাতে হবে। পানি ঠান্ডা হলে মাটির কলস বা কাচের জার বা বোতলে রাখুন। প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার না করাই ভালো।
মনে রাখতে হবে, ডায়রিয়া হলে যে পানিস্বল্পতা ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণ করাই মূল চিকিৎসা। খাওয়ার স্যালাইনে পানিস্বল্পতা দূর করা যায়। মারাত্মক পানিস্বল্পতার লক্ষণ দেখা গেলে রোগীকে শিরায় উপযুক্ত স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। এ জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে শিরাপথে কলেরা স্যালাইন দেওয়া খুবই কার্যকরী। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্স করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে শিশুর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার ও হাইজিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব।
লেখক
জনস্বাস্থ্য গবেষক ও চিকিৎসক
উপ-পরিচালক, সেন্টার ফর ক্লিনিক্যাল এক্সিলেন্স অ্যান্ড রিসার্চ
Discussion about this post