হার্টবিট ডেস্ক
আশ্চর্য হলেও সত্যি যে সমাজে মোটা হলে যেমন কটু কথা আর বক্র চাহনির মুখোমুখি হতে হয়, তেমনি ওজন একটু বেশি কম হলেও একই ধরণের পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। গুগল অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রচুর মানুষ জানতে চাইছেন – ‘আমি কিভাবে মোটা হবো’?
‘ফুঁ দিলে উড়ে যাবে’, ‘বাড়িতে খেতে দেয় না’, ‘সোমালিয়ায় বাড়ি নাকি’, ‘শুঁটকি’, ‘অপুষ্টিতে ভুগতেছে’, ‘দুর্ভিক্ষ’ – এমন নানা তির্যক মন্তব্য আর নেতিবাচক ঠাট্টা মস্করায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায় কারো কারো।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে অনেককে যেমন বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলার জন্য কসরত করতে হয়, তেমনি কিভাবে একটু ওজন বাড়বে তা নিয়েও উন্মুখ থাকেন কেউ কেউ। কিন্তু ওজন বাড়াতে গিয়ে নানারকম ভুল করেন অনেকে, যার ফলে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা মুখে পড়তে হয় অনেককে।
‘সবাই শুঁটকি বলে ক্ষ্যাপাতো’
তামান্না ইয়াসমিন ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক। বাংলাদেশের সমাজে প্রচলিত সুন্দরের হিসাব অনুযায়ী গায়ের রং ও চেহারা মানসম্মত এবং উচ্চতা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি হবার পরও স্কুল জীবন থেকেই ‘শুকনা-পাতলা’ হবার কারণে মানুষের কথা শুনে আসছেন।
ইয়াসমিনের ওজন এখন ৪৬ কেজি, যা তার উচ্চতার তুলনায় বেশ কম।
তিনি বলেছেন, “সবসময় পরিবারে এবং আশেপাশে সবাই শুঁটকি বলে ক্ষ্যাপাতো। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় যখন প্যারেন্টস ডে হত, তখন অন্য অভিভাবকেরা আমার মা-বাবাকে বলতেন, ‘ওর একটু বাড়তি যত্ন নিয়েন’ বা ‘ওকে ডাক্তার দেখান’। তখন আমার সাথে সাথে আমার মা-বাবাও খুবই লজ্জাবোধ করতেন।”
ইয়াসমিন বলেছেন, “কৈশোরের সময় থেকেই আমাকে দুধ, ডিম, মাংস, ঘি, কলা বেশি খেতে হয়েছে। মানে যেগুলো খেলে মানুষ মোটা হয় বলে প্রচলিত আছে, তার সবই চেষ্টা করা হয়েছে।”
এমনকি পড়াশুনা শেষে যখন চাকরিতে ঢুকেছেন, তখনও সহকর্মীদের অনেকে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের অনেকে আড়ালে কোন একটি নাম দিয়ে ডেকেছে।
“অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, পুষ্টিবিদ দেখানো হয়েছে, লাভ হয়নি। কেউ কেউ বলত বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে, হয়নি। তারপর বলেছে বাচ্চা হলে ঠিক হবে, তাও হয়নি,” বলছিলেন তিনি।
তিনি নিজেও এসব নিয়ে বিমর্ষ থাকতেন সব সময়। তবে এখন তিনি সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে বেশি সচেতন, তাই সুস্থ থাকার চেষ্টা করেন সব সময়।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার সাবরিনা সুলতানা। ৪২ বছর বয়সী মিজ সুলতানার ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম, এজন্য তাকে ছোটবেলা থেকে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন এবং কর্মক্ষেত্র সবখানে কটু কথা শুনতে হয়েছে।
সুলতানা এখনো অবিবাহিত। “কিন্তু এজন্য ধরুন অফিস থেকে শুরু করে বাসা সবাই আমার পেছনে বলার চেষ্টা করে যে, শুকনা বলে আমার বিয়ে হয় না। অথচ বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি কারণ আমার মনে হয়েছে আমি আমাদের দেশের প্রচলিত সমাজে মানিয়ে চলতে পারবো না,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলছিলেন, “চারপাশের মানুষ একজন নারীকে যেভাবে দেখে তা আমার কাছে রুচিসম্মত মনে হয় না। আমি কেমন মানুষ সেটা বিবেচনা করা হয় না এখানে, আমার যোগ্যতা কী তাও বিবেচ্য না। বিবেচ্য আমি দেখতে শুটকা-পটকা। আমার মনে হয় আমি এই পরিবেশে মানিয়ে চলতে পারতাম না, তাই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত।”
সুলতানা বলেছেন, অনেকেই আড়ালে তাকে বলে ‘ঠিক সময়ে বিয়ে হয় নাই বলে রগচটা’।
তিনি বলছেন, তার কোন অসুখ বিসুখ নাই, এতেই তিনি খুশি।
মোটা হতে চান অনেক মানুষ
তামান্না ইয়াসমিন এবং সাবরিনা সুলতানা নিজেদের ওজন নিয়ে এখন সন্তুষ্ট থাকলেও সমাজে এখনো অনেক মানুষ আছেন যারা নিজেদের ওজন বাড়াতে চান বলে বলছেন পুষ্টিবিদেরা।
পুষ্টিবিদ এবং ডায়েটিশিয়ান ফারজানা ইসলাম বলছেন, ওজন বেশি হলে তা ঝরিয়ে ফেলার জন্য যেমন মানুষ চিকিৎসক ও ডায়েটিশিয়ানের কাছে যান তেমনি ওজন যাদের কম এখন তারাও চিকিৎসক ও ডায়েটিশিয়ানের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
তিনি বলছেন, তবে এ প্রবণতা মূলত শহর অঞ্চলে বেশি। তবে, অনেকেই এখনো সামাজিক মাধ্যম বা ইউটিউব দেখে নিজের মত করে ওজন বাড়ানো বা কমানোর চেষ্টা করেন, যা নানা রকম শারীরিক ও মানসিক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
কিন্তু কেউ যদি নিজের কম ওজন নিয়ে চিন্তিত হন এবং ভাবেন যে তার মোটা হওয়া দরকার, তাহলে তিনি কী করবেন?
ফারজানা ইসলামের পরামর্শ হচ্ছে এরকম:
নিজের আদর্শ ওজন সম্পর্কে জানুন
সবার আগে নিজের উচ্চতা অনুযায়ী আদর্শ ওজন কত সেটি জানুন। এটি জানতে বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই যা শরীরের আদর্শ ওজন নির্ণয়ের একটি গাণিতিক পদ্ধতি, সেটি সম্পর্কে জানুন।
এর একটি সহজ পদ্ধতি আছে, যেমন আপনার উচ্চতা যত সেন্টিমিটার, তা থেকে ১০০ বিয়োগ করলে আপনি পাবেন কিলোগ্রামে আপনার কাম্য ওজন।
যেমন, আপনার উচ্চতা যদি ১৬২ সেন্টিমিটার হয়, তাহলে কাম্য ওজন হবে অর্থাৎ ১৬২ থেকে ১০০ বাদ দিলে যে সংখ্যা সেটি কেজিতে আসবে ৬২। এবার এ ওজন থেকে মেয়েদের জন্য ১৫ শতাংশ এবং ছেলেদের জন্য ১০ শতাংশ বাদ দিলেই পাবেন আপনার আদর্শ ওজন।
সুষম খাদ্য
মোটা হবার জন্য নির্দিষ্ট দুয়েকটি গ্রুপের খাদ্য মানে কার্বোহাইড্রেট বা চর্বি জাতীয় খাবার বেশি খান অনেকে। তাতে শরীরের ক্ষতি হয়। বরং সব খাদ্য উপাদান রয়েছে এমন খাবার খেতে হবে। এজন্য পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন, চর্বি, দুধ ও দুধজাতীয় খাবার এবং খনিজ উপাদান-সমৃদ্ধ ফলমূল রাখুন খাদ্য তালিকায়। সাথে প্রচুর পানি পান করতে হবে।
সাধারণ নিয়ম হচ্ছে একজন মানুষের উচ্চতার অর্ধেক লিটারে পরিমাপ করে পানি পান করতে হবে।
ব্যায়াম করুন
অনেকে ভাবেন ওজন কমানোর জন্য মানুষ ব্যায়াম করবে। কিন্তু পুষ্টিবিদেরা বলছেন, ওজন কমাতে যেমন ব্যায়াম প্রয়োজন, ঠিক তেমনি ওজন বাড়াতেও ব্যায়াম করা দরকার।
প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যায়াম করলে ক্ষুধা বাড়বে, হজম প্রক্রিয়া ভালো হবে এবং ঘুম ভালো হবে।
এজন্য জিমে যেতে পারেন, চাইলে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করতে পারেন, কিংবা ইয়োগা, সাইক্লিং বা সাঁতারও কাটতে পারেন। শারীরিক কসরতের সাথে মানসিক প্রশান্তির জন্য ইয়োগা করতে পারেন।
সময়মত খাবার খান
খাবারের সময় ঠিক রাখুন। অর্থাৎ সকালের নাস্তা সময়ের অভাবে খেতে পারলেন না, দুপুরে খেতে ইচ্ছে করলো না, কিংবা রাতে একেকদিনে একেক সময়ে খাবার খাচ্ছেন, এসব সুস্থ শরীরের জন্য একেবারেই অনুচিত।
ফলে ওজন বাড়াতে চাইলে বা কমাতে চাইলে এই নিয়ম সবার জন্যই এক। তা হচ্ছে সময়মত খেতে হবে।
বড় কোন অসুবিধা না থাকলে প্রতিদিন একই সময়ে খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন পুষ্টিবিদেরা।
পর্যাপ্ত ঘুমান
শরীরকে যথাযথ কাজ করানোর অবস্থায় সুস্থ রাখার জন্য ঘুম খুবই প্রয়োজন। ওজন বাড়ানোর জন্যও একথা সত্য। প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা অবশ্যই ঘুমাতে হবে।
ঘুম এর থেকে কম হওয়া যাবে না। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে যাওয়া খাবার ঠিকমত হজম হবে না, এবং শরীরে পুষ্টির যোগান ঠিকমত হবে না।
ঘুম যাতে পর্যাপ্ত হয়, সেজন্য সময়মত ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুমানোর আগে একটু হালকা ব্যায়াম করার অভ্যাস করা যেতে পারে।
যেসব ভুল করবেন না
* মোটা হওয়ার জন্য কোন ওষুধের সাহায্য নেবার প্রয়োজন নাই। কোন ভিটামিন, বা অন্য কোন খাদ্য উপাদানের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে করুন।
* পিৎজা, বার্গার, বা কেক-প্যাস্ট্রি, ইত্যাদি খাবার অনেকে ওজন বাড়ানোর জন্য কার্যকর ভেবে খান। সাথে অনেকে ভাজাপোড়া খান। কিন্তু এসব শরীরের ক্ষতি করে। জাঙ্ক ফুড বা প্রক্রিয়াজত খাবার শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
* মোটা হওয়ার জন্য অনেকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খেয়ে থাকেন। এর ফলে শরীরের নানারকম জটিলতা দেখা দিতে পারে, যা নিয়ে সারাজীবনের জন্য ভোগান্তিতে পড়তে পারেন।
* শুকনা বলে লোকে ঠাট্টা করলেও মনে রাখবেন সুস্থতা জরুরি। সেজন্য ওজন কম হলে হীনম্মন্যতায় ভুগবেন না। করো কারো জিনগত কারণেও ওজন কম থাকে, হয়ত চেষ্টা করেও মোটা হতে পারেন না অনেকে। ফলে ভালো দিকটি মাথায় রেখে সন্তুষ্ট থাকুন। সূত্র: বিবিসি
Discussion about this post