টাইপ-২ ডায়াবেটিস কীভাবে হয় তা বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে কীভাবে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এ ব্যাপারে দুটি তত্ত্ব আছে :
তত্ত্ব-১
আমরা যখন প্রাণিজ আমিষ এবং তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত খাবার খাই, তখন এই চর্বি শরীরে গিয়ে কোষে প্রবেশ করে। কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া তখন এই চর্বিকে পুড়িয়ে শক্তি তৈরি করে। কিন্তু অতিরিক্ত তৈলাক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে কোষের ভেতর অধিক পরিমাণে এই চর্বি প্রবেশ করে, যা মাইটোকন্ড্রিয়া পুরোপুরি বার্ন-আউট করতে পারে না। ফলে তা কোষের মধ্যে জমতে থাকে। একপর্যায়ে এই সঞ্চিত চর্বি কোষের স্বাভাবিক কাজে বাধার সৃষ্টি করে।
যদি কেউ আপনার দরজার লক-এ চুইংগাম ঢুকিয়ে দেয়, তখন আপনি যেমন দরজার লক খুলতে পারবেন না তেমনি কোষের ভেতর অতিরিক্ত চর্বি জমার ফলে ইনসুলিন তার স্বাভাবিক কাজ করতে পারে না। কেননা ইনসুলিন রিসেপ্টরের গায়ে চর্বির প্রলেপ জমে গেছে। অর্থাৎ ইনসুলিন কোষের ভেতরে গ্লুকোজ প্রবেশে সাহায্য করতে পারে না, যা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধিতা নামে পরিচিত।
তত্ত্ব-২
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা) এবং চিনিসমৃদ্ধ খাবার (চা কফি জুস পিঠা পায়েস মিষ্টান্ন ও কোমল পানীয় ইত্যাদি) খেলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্লুকোজ রক্তে প্রবেশ করে। লিভার এই অতিরিক্ত গ্লুকোজকে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত করে লিভারেই জমা করে ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্যে।
আবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত এমাইনো এসিড (আমিষের ক্ষুদ্রতম অংশ) রক্তে প্রবেশ করলে তা লিভার কর্তৃক প্রথমে গ্লুকোজ এবং পরে গ্লাইকোজেনে রূপান্তরিত হয়ে লিভারেই জমা হয়। যখন লিভারে আর গ্লাইকোজেন জমা হওয়ার জায়গা থাকে না, তখন লিভার অতিরিক্ত গ্লুকোজকে চর্বি বা ফ্যাটে (ট্রাইগ্লিসারাইড) রূপান্তরিত করে।
এই রূপান্তরিত ফ্যাট লিভার থেকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জমা হতে থাকে, বিশেষ করে মাংসপেশিতে এবং পেটের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন অঙ্গে ও এর চারপাশে। একটা পর্যায়ে এই অতিরিক্ত চর্বি লিভারেও জমা হতে থাকে। ফলাফল ফ্যাটি লিভার, যা প্রকারান্তরে তৈরি করে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হওয়ার পেছনে তত্ত্ব-১ এবং তত্ত্ব-২—এ দুটোর ভূমিকাই থাকে।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ
স্থূলতা
ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স
অতিরিক্ত তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত-কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার
রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (চিনি, সাদা চাল ও সাদা ময়দা)
চিনিসমৃদ্ধ খাবার (চা কফি জুস পিঠা পায়েস মিষ্টান্ন ও কোমল পানীয়)
প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ
শরীরে নাইট্রিক অক্সাইডের উৎপাদন কমে যাওয়া
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব
ক্রমাগত মানসিক চাপ বা স্ট্রেস
ডায়াবেটিসের ক্ষতিকর প্রভাব
দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগলে যে-সব রোগ হতে পারে তার মধ্যে করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ (৭৫% ডায়াবেটিসের রোগী উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত), স্ট্রোক, অন্ধত্ব, কিডনি রোগ, গ্যাংগ্রিন, ক্যান্সার অন্যতম।
টাইপ-২ ডায়াবেটিসের প্রচলিত চিকিৎসা
বিশ্বব্যাপী যত ডায়াবেটিস রোগী আছে তার ৯০ শতাংশই আক্রান্ত টাইপ-২ ডায়াবেটিসে। প্রচলিত চিকিৎসায় বলা হয়, এ রোগ ভালো হয় না। যেহেতু ডায়াবেটিস রোগে রক্তের সুগার লেভেল সহজেই বেড়ে যায়, তাই এর চিকিৎসায় চিনি ও শর্করা জাতীয় খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কম/ পরিমিত খেতে বলা হয় যেন রক্তের সুগার লেভেল বেড়ে যেতে না পারে। অথচ বাস্তবে দেখা গেছে, মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করার পরও ডায়াবেটিস উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। রক্তের এই বাড়তি সুগার কমানোর জন্যে তখন ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
এত কিছুর পরও সুগার নিয়ন্ত্রণ না হলে একপর্যায়ে ইনসুলিন দেয়া হয়। কিন্তু দেখা যায়, প্রচলিত নিয়ম মানার পরও রক্তের সুগার লেভেল নিয়ন্ত্রণ হয় না। ফলে ইনসুলিনের ডোজ বাড়তে থাকে। আবার ইনসুলিন নেয়ার পর শর্করা জাতীয় খাদ্যের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। কেননা একটু এদিক-ওদিক হলে রক্তের সুগার লেভেল অতিরিক্ত কমে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) সৃষ্টি হতে পারে।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
Discussion about this post