বলা হয়ে থাকে, একটি সিগারেটের একপ্রান্তে থাকে আগুন আর অন্যপ্রান্তে থাকে একজন আহাম্মক। যদিও ধূমপান নিয়ে এটি নিছকই একটি কৌতুক, কিন্তু জেনে রাখুন, ধূমপান নীরবে বাড়িয়ে চলেছে আপনার করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি। বিষয়টি যখন আপনার কাছে আরো দৃশ্যমান আর স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ততদিনে হয়তো অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। সচেতন হওয়ার সময় আপনি আর না-ও পেতে পারেন।
ধূমপানকে একসময় পৌরুষের প্রতীক মনে করা হলেও, গত শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা এবং বাংলাদেশে প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে ধূমপানবিরোধী আন্দোলন ‘আধূনিক’ শুরু হওয়ার পর থেকে ধূমপায়ীকে মনে করা হয় সমাজের একজন অসচেতন ব্যক্তি। পৌরুষ তো নয়ই, বরং ধূমপানকে এখন একটি গর্হিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নিকোটিন ।। হার্ট অ্যাটাকের কারণ
সিগারেটে ‘সুখটান’ দেয়া ধূমপায়ীরা কি জানেন, তারা কী পান করছেন? ধূমপানের সঙ্গে তারা প্রায় ৭,০০০ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিজের ভেতরে টেনে নিচ্ছেন, যার সবই শরীরের জন্যে বিষ।
এসব বিষের একটি হলো নিকোটিন। সবচেয়ে ভয়ের কথাটি হলো, এই নিকোটিন হৃৎপিন্ডের করোনারি ধমনীর দেয়ালে অযাচিত সংকোচন ঘটায় (Coronary artery spasm) ফলে ধমনী-পথে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি। গবেষণায় দেখা গেছে, অন্য যে-কারো চেয়ে একজন ধূমপায়ীর হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা ছয় গুণেরও বেশি!
জানা প্রয়োজন, ইতোমধ্যে করোনারি হৃদরোগে ভুগছেন যারা, তাদের জন্যে অনেক সময় একটি সিগারেটও হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় আপনি এমনিতেই ভেঙে পড়েছেন, মুষড়ে পড়েছেন, ভুগছেন মারাত্মক দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেসে। আমরা আগেই জেনেছি, স্ট্রেস হৃৎপিন্ডের করোনারি ধমনীকে সংকুচিত করে। উপরন্তু আপনি টেনশন মুক্তির তথাকথিত উপায় হিসেবে সিগারেট ফুঁকছেন আর পায়চারি করছেন। এদিকে দুয়ে মিলে ধমনীর সংকোচন হঠাৎ আরো বেড়ে যেতে পারে এবং যে-কোনো সময় ঘটে যেতে পারে হার্ট অ্যাটাকের মতো দুর্ঘটনা।
শুধু তা-ই নয়, ধূমপান নানাভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন, ধূমপানের ফলে শরীরের জন্যে উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএলের পরিমাণ কমে যায় এবং বাড়ে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ।
এ-ছাড়াও ধূমপান যে ক্যান্সারের কারণ, এটি এখন আর কারো অজানা নয়। সেইসাথে অন্যান্য রোগঝুঁকি তো আছেই। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণভাবে ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের চেয়ে ২২ বছর আগে মারা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষ প্রাণহানি ঘটে কেবল ধূমপানজনিত রোগের কারণেই।
একজন ধূমপায়ী শুধু যে নিজের ক্ষতিই করেন তা নয়; চরম অসচেতনতার পরিচয় দিয়ে তিনি নির্বিকারে তার চারপাশের মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিও করে যাচ্ছেন। বলা হয়, প্রত্যক্ষ ধূমপানের চেয়ে পরোক্ষ ধূমপান (Passive smoking) কোনো অংশে কম ক্ষতিকর নয়। অর্থাৎ একজন ধূমপায়ীর সিগারেটের ধোঁয়া থেকে তার স্বামী/ স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সদস্য এবং সহকর্মী প্রিয়জন কেউই ঝুঁকিমুক্ত নন।
তাই হৃদযন্ত্রের সুস্থতা তো বটেই, সেইসাথে নিজের ও প্রিয়জনদের সার্বিক সুস্থতা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্যেই আমাদের প্রয়োজন ধূমপানমুক্ত সুস্থ সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা।
লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া।
Discussion about this post