হার্টবিট ডেস্ক
দীর্ঘ সময় বসে থাকা এবং শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় জীবনযাপনের কারণে বৃটেনে প্রতি বছর ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। এজন্যে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রতি বছর গুণতে হয় ৭০ কোটি ইউরো। সারা বিশ্বের হিসেবে এর সংখ্যা ৫ মিলিয়নেরও বেশি।
কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে যদি এই পরিমাণ মানুষ মারা যেত তাহলে তাকে ‘অতিমারী’ শুধু নয়, হয়তো তার চেয়েও বেশি নামে ডাকা হতো। অথচ এটাই সত্যি, এমনটিই ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বসে থাকা এবং নিস্ক্রিয় জীবন যাপনের সাথে পাঁচটি স্বাস্থ্যঝুঁকির সরাসরি যোগ আছে-
১. টাইপ টু ডায়াবেটিস, ২. হৃদরোগ, ৩. কোলন ক্যান্সার, ৪. জরায়ুর ক্যান্সার, ৫. ফুসফুসের ক্যান্সার।
বসে থাকা কেন এত ক্ষতিকর?
প্রথম কারণ হলো- স্রষ্টা এই দেহটাকে আসলে তৈরি করেছেন বসে থাকা নয়, চলাফেরার জন্যে। প্রমাণ চান? দেখুন আপনার দেহের ভেতরে কী আছে!
আপনার দেহে আছে ৩৬০টি জয়েন্ট এবং ৭০০ পেশীর হাড়। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো ইচ্ছেমতো দেহকে নড়চড়া করানো। অসাধারণ এই গঠনের কারণেই গ্রাভিটির বিপরীতেও আমরা সোজা হয়ে সুন্দরভাবে দাঁড়াতে পারি। আপনার চামড়াকে দেখুন। নড়াচড়ার সুবিধার জন্যেই এটা ইলাস্টিকের মতো নমনীয়! দেহের ভেতরে অবিশ্রান্ত চলছে যে রক্তপ্রবাহ তা তত ভালো হবে যত এই দেহটা থাকবে সচল। তার মানে দেহের প্রতিটি ইঞ্চিই তৈরি নড়াচড়ার উপযোগী করে। নড়াচড়া করলেই এরা ভালো থাকবে।
কিন্তু সেটা যখন করেন না তখন কী হয়?
প্রথম শিকার মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড হলো একটা লম্বা কাঠামো যাতে আছে হাড় ও ডিস্ক। জয়েন্ট, মাসল এবং লিগামেন্টগুলো এই হাড়ের সাথেই লেগে থাকে। পিঠ বাঁকিয়ে এবং মাথা ঝুঁকিয়ে আপনি যখন চেয়ারে বসেন, একটা অস্বস্তিকর চাপ পড়ে আপনার মেরুদণ্ডের ওপর। ফলে মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোর ক্ষয় হয়, ক্ষয়ে যায় জয়েন্ট ও লিগামেন্ট। পেশীর ওপর তৈরি হয় অতিরিক্ত চাপ! দ্বিতীয় শিকার ফুসফুস। বসে থাকার সময় আপনার বক্ষখাঁচা সংকুচিত হয়ে থাকে। ফলে কমে যায় ফুসফুসের প্রসারণ ক্ষমতা। আর ফুসফুসের প্রসারণ ক্ষমতা কমা মানে রক্তের অক্সিজেন প্রবাহ কমা। লম্বা সময় ধরে বসে থাকলে রক্তের লাইপোপ্রোটিন লাইপেজ কমে যায়। বিশেষ এক এনজাইম, যা রক্তের ফ্যাট বা চর্বি ধ্বংস করে। যত আপনি বসে থাকছেন, তত কম ফ্যাট ধ্বংস হচ্ছে আপনার দেহ থেকে। বসে কি ব্রেনকে বেশি কাজে লাগানো যায়? সাধারণভাবে মনে করা হয়- বসলে বোধ হয় ব্রেনকে বেশি কাজে লাগানো যাবে। ভুল! বরং বাস্তবতা হচ্ছে, যত বেশি আপনি বসেন, তত এর উল্টোটাই ঘটে। বসলে দেহের রক্তপ্রবাহ কমে। কমে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা। ব্রেনের সক্রিয়তা কমাতে এ দুটো কারণই যথেষ্ট। কাজেই বেশিক্ষণ বসে থাকলে আপনার আসলে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতাটাই কমে যাচ্ছে। তাহলে প্রতিকার?
কাজের ফাঁকে ফাঁকে আপনার মেরুদন্ডটা একটু সটান করে বসুন এবং উঠে দাঁড়াবার সুযোগ পাওয়ামাত্রই তা গ্রহণ করুন। প্রতি আধঘণ্টায় অন্তত একবার আপনি উঠে দাঁড়াবেন এবং একটু হাঁটাহাঁটি করবেন – নিজের জন্যে এরকম একটা অভ্যাস তৈরি করুন। আর একটি আসন করতে পারেন। যার নাম বঙ্গাসন।
কীভাবে বসবেন?
মেঝেতে বা ম্যাটে হাঁটু থেকে পা ভাঁজ করে বসুন। পায়ের পেশীর সাথে ঊরুর পেশী লেগে থাকবে এবং নিতম্ব মেঝে স্পর্শ করবে না। শরীরের উপরের অংশ সামনের দিকে বেশি না-ঝুঁকিয়ে মেরুদণ্ড যথাসম্ভব টান টান রাখার চেষ্টা করুন। পায়ের আঙুলগুলো মেঝেতে লেগে থাকবে, ভর থাকবে পায়ের গোড়ালিতে। দু’পায়ের মাঝে ফাঁকা থাকবে এক হাত বা যতটুকু আরামদায়ক হয় ততটুকু। হাত দুটো থাকবে হাঁটু ঘিরে অথবা হাঁটুর ওপরে। শরীরের ভর ছেড়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় স্থির থাকুন। ব্যাস, হয়ে গেল বঙ্গাসন! সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ বঙ্গাসন করছে। যেদিন থেকে মানুষ বসতে শিখেছে সেদিন থেকেই সে বঙ্গাসন করছে। যুগ যুগ ধরে বঙ্গের মানুষ, মানে আমাদের পূর্বপুরুষরা এভাবে জিয়াফতে বসতেন, কথা বলতেন, অপেক্ষা করতেন সবকিছু করতেন। যে-কারণে এই আসনকে আমরা বলছি বঙ্গাসন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ১৯৭৮ সালের বড়দিনের সময় মারাত্মক এক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে এক সপ্তাহ রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। যে অসুখটি তার হয়েছিল তার নাম হেমোরয়েড। হেমোরয়েড হলো পায়ুপথের একটি রোগ যাতে পায়ুর শিরা ফুলে যায় ও মলত্যাগের সময় রক্ত পড়ে। তার প্রক্টোলজিস্ট (পায়ুপথ রোগ বিশেষজ্ঞ) বলেন, কমোড ব্যবহারের ফলেই প্রেসিডেন্ট অসুস্থ হয়েছেন।
আমেরিকান কলেজ অব গেস্ট্রোএন্টারোলজির পরিসংখ্যান হচ্ছে, বয়স ৫০ হওয়ার আগেই আমেরিকার অর্ধেক মানুষ হেমোরয়েডে ভুগতে শুরু করেন। আর এর অন্যতম কারণ হলো কমোডের ব্যবহার। কমোডে বসলে মলদ্বার পুরোপুরি প্রশস্ত হতে পারে না। পেটে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি চাপ পড়ে। পায়ুপথে শিরা টান খায় ও ফুলে যায়। যে কারণে দীর্ঘদিন ধরে কমোডে যারা অভ্যস্ত তারা হেমোরয়েড ও কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আর ক্লিনিকাল রিসার্চে বঙ্গাসনকে তো পাইলসের জন্যে অত্যন্ত কার্যকরী ‘ন্যাচারাল ট্রিটমেন্ট’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্গাসনকে আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ একটি আসন মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে যোগের অসাধারণ একটি আসন এটি, যার উপকারিতা সম্পর্কে জানলে আপনার চোখ কপালে উঠবে!
১. মেদভুঁড়ি দূর করে, বাড়তি ওজন কমায়। দেহে পেশী যত সক্রিয় থাকবে মেদ কমাতেও তা তত সহায়ক হবে। বঙ্গাসনে দেহের পেশী সক্রিয় থাকে বলে তা অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন করে। ফলে দূর হয় মেদ। অতিরিক্ত ওজনও আপনি কমাতে পারেন বঙ্গাসন করে।
২. রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। বঙ্গাসন করার সময় কাফ মাসল এবং হিপ এবং পেটে টান পড়ে। ফলে সেখানে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। এতে কমে রক্তের কোলেস্টেরল। কারণ মাসলগুলো তখন এই কোলেস্টেরলকে বার্ন আউট করে ফেলে। রক্তে কোলেস্টেরল কমার সাথে সাথে কমে যায় হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও।
৩. নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বাড়ায়। কোনো তরুণী যদি নিয়মিত বঙ্গাসন করেন তাহলে মা হবার সময় তার নরমাল ডেলিভারির সম্ভাবনা বেড়ে যায়-গবেষণালব্ধ তথ্য এটা। দেখা গেছে বঙ্গাসন করতে পারেন এমন মায়েদের ২০ থেকে ৩০ ভাগ ক্ষেত্রে বেশি নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। তা-ছাড়া প্রসব বেদনা লাঘবেও এই আসন চর্চা কাজে দেয়।
৪. বাতব্যথা থেকে মুক্ত থাকতে বঙ্গাসন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হিপ থেকে শুরু করে নিচের দিকের অঙ্গগুলোতে ও হাড়ে ব্যথা-বেদনা বাড়তে থাকে অনেকেরই। বিশেষত চল্লিশের পরে এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ বাতের প্রথম আক্রমণই হয় কোমর থেকে হাঁটু এবং পায়ে। তাই বজ্রাসন-বঙ্গাসন-দণ্ডাসন এই ধারাবাহিকতা আপনি যখন অনুসরণ করবেন তখন আপনার পায়ের এইসব অঞ্চলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যাবে। ফলে শক্ত থাকবে আপনার পা, আপনি তত মুক্ত থাকবেন বাতব্যথা থেকে।
৫. লোয়ার ব্যাকপেইন লাঘব করে। সামনে ঝুঁকে সাইকেল চালানো কিংবা ল্যাপটপ/ডেস্কটপের সামনে ঝুঁকে লম্বা সময় কাজের অভ্যাস আছে অনেকেরই। ঝুঁকে করা এমনসব কাজে পিঠের নিচের অংশ দীর্ঘ সময় বেঁকে থাকার ফলে লোয়ার ব্যাকপেইনে ভোগেন তারা। এই ভোগান্তি নিরসনের উত্তম দাওয়াই- বঙ্গাসন! কারণ এই আসন করলে পিঠের নিম্নভাগ প্রসারিত হয়, যা টান খাওয়া মাসলকে স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসে। তা-ছাড়া এসময় ওইসব অংশে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। এতে টান খাওয়া মাসলগুলো শিথিল হয় এবং ব্যাথা উপশম হয়।
৬. বাড়ায় দেহের সার্বিক সক্ষমতা। বঙ্গাসনে তলপেটের পেশী, হিপ মাসল (গ্লুটস), উরুর পেশী (কোয়াড্রিসেপস ও হ্যামস্ট্রিংস), কাফ মাসল, পিঠের পেশী ইত্যাদি সঞ্চালনের ফলে সেগুলো মজবুত হয়। ফলে সামগ্রিকভাবে পুরো দেহের শক্তিমত্তা বেড়ে যায় এই আসন চর্চায়। কাজেই ক্রীড়াবিদদের মধ্যে যারা দুর্বল টিস্যু ও লিগামেন্টের কারণে ঘন ঘন আহত হন তারা এই আসন চর্চা করে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন।
এই আসনের সুবিধা হলো, এর জন্যে আপনাকে বিশেষ কোনো প্রস্তুতি নিতে হবে না। এমনকি ভরাপেটেও করা যায় এই আসন! তবে শুরুতেই এই আসনে হয়তো বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন না। প্রথমবার চেষ্টা করলে হয়ত মিনিটখানেক থাকতেই কষ্ট হবে। একটু একটু করে সময় বাড়ান। প্রথমে ২০ সেকেন্ডে, তারপর ৪০ সেকেন্ড; আস্তে আস্তে ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৩ মিনিট। বঙ্গাসন করতে গিয়ে অসুবিধা হলে এরপরে করবেন বজ্রাসন। সবশেষে দণ্ডাসন। এভাবে দিনে অন্তত ১৫ মিনিট বঙ্গাসন-বজ্রাসন-দন্ডাসন করুন পর্যায়ক্রমে।
আমরা শুরু করেছিলাম যে বসার ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলে তা হলো চেয়ারে বসা। চেয়ারে বসাকে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা এখন বলছেন নেক্সট স্মোকিং। মানে ধূমপানের মতোই এমনকি তার চেয়ে জীবনহারি হতে পারে এই চেয়ারে বসা।
ডাঃ জেমস লেভাইন তার লেখা ‘Get Up!: Why Your Chair is Killing You and What You Can Do About It’ বইয়ে বলেছেন, Sitting is more dangerous than smoking, kills more people than HIV and is more treacherous than parachuting. We are sitting ourselves to death,”
অর্থাৎ, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আরাম কেদারা বা সোফায় গা এলিয়ে বসে থেকে প্রকারান্তরে মৃত্যুকেই ডেকে আনছেন আপনি! তাই চেয়ার-সোফা ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে বঙ্গাসনে বসার অভ্যাস করুন। আর এভাবে বঙ্গাসনে বসাকে ধীরে ধীরে পরিণত করুন পারিবারিক অভ্যাসে। তবে অন্যদের ওপর চাপিয়ে না দিয়ে শুরুটা করুন নিজেকে দিয়ে। বাসায় চেয়ার বা সোফায় বসা বাদ দিন। যে কাজগুলো আপনি বসে বসে করেন সেগুলো এখন থেকে বঙ্গাসনে বসে করার অভ্যাস করুন। পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলছেন- বঙ্গাসনে বসে বলুন। টিভি দেখছেন- বঙ্গাসনে বসে দেখুন। মোবাইলে কথা বলছেন- বঙ্গাসনে বসে বলুন। অবসর কাটান বঙ্গাসনে বসে। এ-জন্যে বাসায় সবসময় মাদুর রাখুন, যাতে চেয়ারে না বসে বঙ্গাসনে বসতে পারেন।
অন্যরা শুরুতে হয়তো হাসাহাসি বা কটাক্ষ করবে। অহেতুক বিতর্কে না জড়িয়ে নিজের চর্চাটা চালিয়ে যান। একটা সময় দেখবেন আপনাকে দেখে পরিবারের অন্যরাও উদ্বুদ্ধ হবে বঙ্গাসন করতে।
Discussion about this post