হার্টবিট ডেস্ক
দেশে এখন চলছে গ্রীষ্ফ্মের তাপদাহ। চৈত্রের শুরু থেকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধারা বৈশাখে এসেও অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে বাড়ছে গ্রীষ্ফ্মকালীন রোগব্যাধিও। সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ডায়রিয়া। চলতি বছর হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারাদেশে এর সংক্রমণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বাস্থ্য বিভাগ কলেরার মুখে খাওয়ার টিকা বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ডায়রিয়ার পাশাপাশি আবারও ফিরে এসেছে চিকেন পক্স বা জলবসন্ত, হিট স্ট্রোক, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গুসহ কয়েকটি পুরোনো সংক্রামক রোগ। স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষকে এখন করোনাভাইরাসের পাশাপাশি এসব রোগ মোকাবিলারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম সারাদেশে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ করে। ওই তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত একক রোগ হিসেবে শীর্ষে অবস্থান করছে ডায়ারিয়া। এই সময় সারাদেশে চার লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের একজন কক্সবাজার এবং অন্যজন লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা। এ ছাড়া রাজধানীর ২৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসার পথেই মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন আইসিডিডিআর,বির এক কর্মকর্তা।
ডায়রিয়া আক্রান্ত শীর্ষ অঞ্চল ঢাকা বিভাগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ২৪৭ জন। এর পর আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন পর্যায়ক্রমে খুলনায় এক লাখ এক হাজার ৮১৯ জন, চট্টগ্রামে ৫১ হাজার ৫৯৬ জন, রাজশাহীতে ৩৭ হাজার ৬০৩ জন, রংপুরে ৩৪ হাজার ৮১৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩২ হাজার ৯৩৮ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩২ হাজার ১৮৬ জন এবং বরিশালে ১১ হাজার ৪০৩ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, চলমান ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে মুখে খাওয়ার টিকা বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচির আওতায় সংক্রমণপ্রবণ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, দক্ষিণখান, মিরপুর, মোহাম্মদপুর ও সবুজবাগ এলাকার ২৩ লাখ মানুষকে কলেরার টিকা খাওয়ানো হবে। এসব এলাকার গর্ভবতী নারী ছাড়াও এক বছরের বেশি সব বয়সের মানুষ পরপর দুই মাস দুই ডোজের এ টিকা পাবেন। আগামী মে মাসে প্রথম ডোজ এবং জুন মাসে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া হবে। টিকা পেতে এসব এলাকার বাসিন্দাদের কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। টিকা গ্রহণের সময়সূচিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবাইকে জানাবে। প্রয়োজনে অন্যান্য এলাকার বাসিন্দাদের জন্যও এ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ডায়রিয়ার চলমান প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে এডিস মশা। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে রাজধানীর চার দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব মিলেছে, যা গত বছরের চেয়ে এক শতাংশ বেশি। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। তাদের মধ্যে মারা যান ১০৫ জন। চলতি বছর এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৭৭ জন। তবে এখনও কারও মৃত্যু হয়নি। তবে এখনই সতর্ক না হলে চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, রাজধানীতে প্রাক-মৌসুমে এডিস মশার ঘনত্ব গত বছরের তুলনায় বেশি। কারণ করোনা সংক্রমণ কমে আসায় নির্মাণকাজ আবারও শুরু হয়েছে। সামনে বৃষ্টিপাত শুরু হলে মশার ঘনত্ব আরও বাড়বে। এ কারণে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। সুতরাং মশা নিধনে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি করপোরেশনকে এক সঙ্গে কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন।দেশের পার্বত্য তিনটিসহ ১৩ জেলায় কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণে থাকা ম্যালেরিয়ার বিস্তার সম্প্রতি ঊর্ধ্বমুখী। গত বছর ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত
হয়েছেন ছয় হাজার ১৩০ জন, মারা গেছেন ৯ জন। চলতি বছর ম্যালেরিয়ায় এ পর্যন্ত ৬০১ জন আক্রান্ত এবং একজন মারা গেছেন। সামনে বর্ষা মৌসুমে ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. একরামুল হক বলেন, দেশের ১৩ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপের কথা বলা হলেও রোগী বেশি মূলত পার্বত্য তিন জেলায়। কয়েকটি জেলায় এটির সংক্রমণ ঘটেছে সংক্রমিত এলাকা থেকে। বর্তমানে কয়েকটি জেলাকে ম্যালেরিয়ামুক্তও ঘোষণা করা যায়। তবে পার্বত্য তিন জেলার ওপর নজর রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ জন্য কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছে।
এদিকে হঠাৎ করেই বেড়েছে নিয়ন্ত্রণে থাকা চিকেন পক্স বা জলবসন্তও। গত দেড় থেকে দুই মাস ধরে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রতি বছর বসন্ত ঋতু আগমনের সঙ্গে সঙ্গে জলবসন্তের সংক্রমণ ঘটে। তথ্য-উপাত্ত না থাকলেও চিকিৎসকরা বলেছেন, আগের তুলনায় জলবসন্ত বা চিকেন পক্সে আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জলবসন্তের রোগী গত বছরের তুলনায় এবার কিছুটা বেশি। সংক্রামক রোগ হওয়ায় অন্যান্য রোগীর সঙ্গে জলবসন্তের রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয় না। এ কারণে তাদের সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে পাঠানো হয়। তবে শিশু রোগীদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই জলবসন্তে আক্রান্ত রোগীর নিউমোনিয়া হলে তাকে হাসপাতালে আইসোলেশনে রেখে দেওয়া হয়। এ ধরনের কিছু রোগী তাদের হাসপাতালেও ভর্তি করা হয়েছে।
তীব্র গরমে শরীরের তাপমাত্রা বাড়লে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক সময় এতে রোগীর মৃত্যু হয়। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ দশমিক ৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ১০৪ ডিগ্রির বেশি হলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়। মস্তিস্কের যে অংশটি শরীরের তাপমাত্রা নিযন্ত্রণ করে, তীব্র তাপমাত্রার কারণে সেটি শরীরের ওপর নিযন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তখন মানুষ অচেতন হয়ে পড়তে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে ‘হিট স্ট্রোক’ বলা হয়। গত বছর মে মাসে তীব্র গরমে শিমুলিয়া ফেরিঘাটে হিট স্ট্রোকে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, হিট স্ট্রোকের প্রধান কারণ পানিশূন্যতা। সুতরাং তীব্র গরমে শরীরে যাতে পানিশূন্যতা না হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসার অংশ হিসেবে আক্রান্ত রোগীকে ছায়ায় নিতে হবে। শরীরে ঠান্ডা পানি ঢালতে হবে। সম্ভব হলে রোগীকে ফ্যানের নিচে অথবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) কক্ষে নিতে হবে। রোগীর বগল ও ঊরুর ভাঁজে বরফ দেওয়া যেতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে না আসা পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, গত দুই বছর করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদিকে বিশ্বের কয়েকটি দেশে নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। সুতরাং বাংলাদেশেও এটি আবারও ছড়াতে পারে। তাই করোনা মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখতে হবে। একই সঙ্গে ডায়রিয়ার সংক্রমণ শুরু হলে তা প্রতিরোধের পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া নিয়েও উদ্বেগ আছে। সরকারি হাসপাতাল ও সংশ্নিষ্ট শাখাগুলোকে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
Discussion about this post