এম এ খান
রক্ত শরীরের একধরনের বিশেষ (টিস্যু) জলীয় অংশ। এর মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের কণিকা। যেমন লোহিত রক্তকণিকা (আরবিসি), শ্বেত রক্তকণিকা (ডব্লিউবিসি) ও অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট)। এসবই অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারো থেকে উৎপন্ন হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে শরীরের বিভিন্ন স্থানে পরিপক্বতা লাভ করে। রক্তের রং লাল হওয়ার কারণ লোহিত কণিকার মাধ্যমে হিমোগ্লোবিনের রং লাল। ধরন অনুযায়ী রক্তকণিকার রয়েছে বিশেষ ধরনের কাজ।
লোহিত রক্তকণিকা
ফুসফুস থেকে অক্সিজেন বহন করে শরীরের সর্বত্র সরবরাহ করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ফুসফুস দিয়ে বের করে দেয়। শরীরের কোনো স্থানে কয়েক মিনিটের জন্য রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলে অক্সিজেনের অভাবে ওই স্থানে ইনফার্কশন হয়, যেমন স্ট্রোক, গ্যাংগ্রিন।
শ্বেত রক্তকণিকা
শ্বেত রক্তকণিকাগুলো দেহে রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলে। এটি অনেকটা পুলিশের মতো কাজ করে। শ্বেত রক্তকণিকা শরীরের সেলুলার ও হিউমোরাল ইমিউনিটি গড়ে তোলে, যা শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
অণুচক্রিকা
অতি ক্ষুদ্র অথচ খুবই প্রয়োজনীয় রক্তকণিকা, যা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য জরুরি। সাধারণত রক্তে এর পরিমাণ দেড় থেকে সাড়ে চার লাখ। রক্তে যদি কোনো কারণে এর পরিমাণ ৩০ হাজারের কম হয়, তবে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া রক্তের জলীয় অংশে রয়েছে নানা ধরনের প্রোটিন ও কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর (যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে)।
রক্তরোগের লক্ষণ কী কী
রক্তের উপাদানগুলোর বিশেষ বিশেষ কাজ রয়েছে। যদি এগুলো সঠিক মাত্রায় উৎপন্ন না হয়, তাহলে রক্তশূন্যতা, রক্তক্ষরণ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গিয়ে ইনফেকশন হয়ে থাকে।
* রক্তশূন্যতাজনিত লক্ষণ অবসাদ ও দুর্বলতা, বুক ধড়ফড় করা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
* শরীরে সংক্রমণের প্রবণতা বাড়ে। ফলে লাগাতার জ্বর থাকে।
* রক্তক্ষরণজনিত সমস্যা। ত্বক, নাক, মাড়ি, চোখে রক্তক্ষরণ, মাসিকের সময় বেশি বেশি রক্ত যাওয়া ইত্যাদি।
* শরীর বা হাড়ে ব্যথা, জোড়ায় ব্যথা।
* লিভার ও স্প্লিন বেড়ে যাওয়া।
* গলা, বগল ও অন্যত্র লিমফনোড (লসিকা গ্রন্থি) বড় হওয়া
* কোনো কোনো সময় কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা ও পর্যায়ক্রমে শরীরের নিম্নাঙ্গ প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে।
* জয়েন্ট ফুলে যাওয়া, ব্যথা হওয়া, ক্ষতস্থান দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া ইত্যাদি।
তবে মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ একসঙ্গে দেখা দেয় না। এসব লক্ষণ অন্যান্য রোগেও দেখা দিতে পারে।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন একধরনের আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা। শরীরের অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মতো বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সার্জারি বা অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না।
রোগীর অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত অস্থিমজ্জা কেমোথেরাপি মাধ্যমে নষ্ট করে (কন্ডিশনিং) দাতা বা ডোনারের থেকে বিশেষ ধরনের রক্তকোষ বা স্টেমসেল (সিডি-৩৪+) নিয়ে (হার্ভেস্টিং) রোগীর শরীরে ঢোকানো হয় (অনেকটা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের মতো)। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে স্টেমসেল থেকে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হতে শুরু করে। আর রোগী ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে। যদিও এ অবস্থার প্রথম তিন মাস রোগীর জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় নানা ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালে প্রথম সাফল্যের সঙ্গে ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোমের জন্য এবং ১৯৭২ সালে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার জন্য বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করা হয়। ডোনেল থমাস ১৯৭০ সালে এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন মূলত দুই ধরনের
অ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন: অন্যের শরীর থেকে (এইচএলএ ম্যাচিং ডোনার) স্টেমসেল সংগ্রহ করে রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করাকে অ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বলে।
অটোলগাস বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন: রোগীর নিজের শরীরের বোনম্যারো সংগ্রহ করে পুনরায় তার শরীরে প্রতিস্থাপন করাকে অটোলগাস বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বলে।
স্টেমসেল কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়
স্টেমসেল সংগ্রহ করাকে হারভেস্টিং বলে। নিচে উল্লেখ জায়গাগুলো থেকে স্টেমসেল সংগ্রহ করা হয়।
অস্থিমজ্জা: দাতা বা ডোনারকে অজ্ঞান করে তার কোমরের হাড় (পেলভিক বোন) থেকে প্রায় ৫০০ মিলিলিটার রক্ত সংগ্রহ করতে হয়।
পেরিফেরাল ব্লাড: রক্ত থেকে অ্যাফেরেসিসের মাধ্যমে স্টেমসেল সংগ্রহ করা হয়। এর জন্য ডোনারকে ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
ডোনার কীভাবে বাছাই করা হয়
ডোনার বাছাই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন ভাইবোনদের এইচএলএ টাইপিং (এ, বি, সি, ডিআর, ডিকিউ) করে যার সঙ্গে ১০০ শতাংশ মিলবে, তাকে ডোনার হিসেবে গ্রহণ করা। অনেকের ধারণা, রক্তের গ্রুপ এক হলেই চলবে, আসলে তা ঠিক নয়। প্রতিস্থাপনের পর রোগীর ব্লাড গ্রুপ পরিবর্তন হয়ে ডোনারের ব্লাড গ্রুপ হয়ে যায়। ডোনার ও রোগীর এইচএলএ টাইপিংয়ে যত অমিল হবে, তত বেশি আশঙ্কা থাকে গ্রাফট রিজেকশনর, গ্রাফট বনাম হোস্ট ডিজিজ এবং মৃত্যুর। এ থেকেই বোঝা যায়, শতভাগ ম্যাচ ডোনার সিলেকশন কত গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে এইচএলএ ম্যাচ ভাইবোন ডোনার হিসেবে পাওয়া যায়। ফলে অনাত্মীয় দাতার ওপর অনেক ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয়।
রক্তরোগ কোনগুলো
এককথায় বলতে গেলে রক্তের উপাদান থেকে সৃষ্ট রোগগুলোই রক্তরোগ। প্রধান ১০টি রক্তরোগ হলো:
* নানা ধরনের রক্তশূন্যতা (আয়রন ও ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে)
* থ্যালাসেমিয়া ও হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া (লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিক সময়ের আগেই ভেঙে যায়)
* অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া (রক্ত উৎপাদিত হয় না)
* ব্লাড ক্যানসার(অ্যাকিউট ও ক্রনিক লিউকেমিয়া)
* মাল্টিপল মাইলোমা (প্লাজমা সেলের ক্যানসার)
* লিমফোমা (লসিকা গ্রন্থি বা লিমফোসাইটের ক্যানসার)
* ব্লিডিং ডিজঅর্ডার (যেমন হিমোফিলিয়া, আইটিপি, ডিআইসি এবং রক্ত জমাট না বাঁধার কারণে রক্তক্ষরণ)
* মাইলোডিসপ্লাস্টিক সিনড্রোম (অস্বাভাবিক রক্তকণিকা তৈরি ও ভেঙে যাওয়া)
* মাইলোফাইব্রোসিস (বোনম্যারোতে ফাইব্রাস টিস্যু বেড়ে যাওয়া)
* পলিসাইথেমিয়া (রক্তের লোহিতকণিকা ও হিমোগ্লোবিনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি)
প্রতিস্থাপনের শুরু করতে কী কী প্রয়োজন
* নির্দিষ্ট পরিমাপের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লিন’ ঘর
* প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, উন্নত মানের ল্যাবরেটরি ও আধুনিক ব্লাড ট্রান্সফিউশন বিভাগ
* দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান, নার্স ও চিকিৎসক (জুনিয়র ও সিনিয়র হেমাটোলজিস্ট)
* সমন্বিত চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে (অর্থাৎ মেডিসিনের সব বিভাগ বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন)
* বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন পরিবর্তন পেশেন্ট সাপোর্ট ও মনিটরিংয়ের প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা থাকতে হবে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী ধরনের
ক্ষেত্রবিশেষে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কার্যকর। এ ক্ষেত্রে জটিলতাও আছে। যেমন
* ইমিউন রিঅ্যাকশন
* গ্রাফট ফেইলর বা রিজেকশন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ হতে পারে
* সংক্রমণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। ব্যাকটেরিয়াল, ছত্রাকজনিত, ভাইরাস ও নিউমোসিস্টিক কারিনি ইনফেকশন বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন–পরবর্তী জীবননাশের কারণ হতে পারে
* এ ছাড়া বন্ধ্যত্ব, সেকেন্ড ম্যালিগন্যান্সি, এনডোক্রাইন সমস্যা, ক্যাটার্যাক্ট হতে পারে।
* অ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা কী
শরীরের রক্তকণিকাগুলোর বিশেষ কাজ রয়েছে। এই রক্তকণিকাগুলো প্রাথমিকভাবে বোনম্যারোতে উৎপন্ন হয়ে থাকে। যদি এসব কণিকা সঠিক মাত্রায় উৎপন্ন না হয়, তাহলে রক্তশূন্যতা, রক্তক্ষরণ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গিয়ে ইনফেকশন হবে। এ কারণে রোগীর মৃত্যু অবধারিত হয়ে পড়ে। আমরা জানি, ব্লাড ক্যানসারসহ কিছু ক্যানসার কেমোথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করা হলেও পূর্ণ নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এসব ক্ষেত্রে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন একমাত্র সম্ভাবনাময় চিকিৎসা। উদাহরণ হিসেবে কিছু রোগের নাম উল্লেখ করা হলো, যেখানে বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন প্রয়োজন হয়।
*লেখক: অধ্যাপক ডা. এম এ খান, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, হেমাটোলজি ও হেমাটো-অনকোলজি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
Discussion about this post