ডা. মো. শওকত আলী
১.
রানী (ছদ্মনাম)। বয়স এক বছর। কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক ধ্বনি উচ্চারণ করতে পারে না। জন্মের সময় কাঁদতে দেরি করেছে। হাত ও পা শক্ত করে রাখে। এখনো নিজে নিজে বসতে পারে না।
২.
মাহী (ছদ্মনাম)। বয়স দুই বছর। শুধু ‘মা’ শব্দটি বলতে পারে। দেরিতে কথা বলা নিয়ে মা-বাবা উদ্বিগ্ন। সমবয়সী অন্য বাচ্চারা অনেক কথা বলতে পারে। মাহীর অন্য কোনো সমস্যা নেই। তবে তার বড় বোনেরও দেরিতে কথা বলার ইতিহাস ছিল।
৩.
সানীর (ছদ্মনাম) বয়স তিন বছর। সে কোনো কথা বলে না। ডাকলে তাকায় না। কোনো শব্দের দিকে খেয়াল করে না। জন্মের সময় স্বল্প ওজন এবং তুলনামূলক ছোট মাথা নিয়ে জন্মেছিল। তার মায়ের গর্ভকালীন প্রথম তিন মাসের সময় জ্বরের সঙ্গে শরীরে লাল লাল দাগ ওঠার ইতিহাস আছে।
৪.
সুজাতার (ছদ্মনাম) বয়স চার বছর। সে ঠিকমতো কথা বলে না। কারও দিকে চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। নিজে নিজে কথা বলে। একই কথার পুনরাবৃত্তি করে। সমবয়সীদের সঙ্গে মেশে না।
ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ
রানীর সমস্যাটির নাম সেরিব্রাল পালসি। জন্মের পরপর শ্বাস না নেওয়ার কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। এতে বিভিন্ন রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এই বাচ্চারা শ্রবণের সমস্যা অথবা ধ্বনি উচ্চারণের জন্য ব্যবহৃত অঙ্গের যথাযথ ও সমন্বিত কার্যক্রমের ব্যাঘাত ঘটার কারণে কথা বলতে পারে না অথবা কথোপকথনে অসুবিধা হয়ে থাকে।
মাহীর দেরিতে কথা বলা স্বাভাবিক দেরি (কনস্টিটিউশনাল স্পিচ ডিলে) ধরে নেওয়া যায়। এই শিশুরা নিকট ভবিষ্যতে ধীরে ধীরে কথা বলা শিখে ফেলে।
মাতৃগর্ভকালীন জীবাণুর (টর্চ) সংক্রমণের কারণে সানীর শ্রবণশক্তি হারিয়ে গেছে। শব্দতরঙ্গ মস্তিষ্কে না পৌঁছার কারণে শব্দের অনুভূতিই তৈরি হয় না সানীর।
সুজাতা অটিজমে ভুগছে। এ রোগের একটি উপসর্গ হলো দেরিতে কথা বলা অথবা আদৌ কথা না বলা। ধ্বনি, শব্দ অথবা বাক্যের মাধ্যমে ভাব প্রকাশে মস্তিষ্কের যে উন্নয়ন দরকার, সেটা তাদের হয় না। শিশুর মুখে ‘মা’ ডাকে নিশ্চিতভাবেই সব মায়ের হৃদয় জুড়িয়ে যায়। শিশুর মুখে স্বাভাবিক কথা না শোনার কারণে অনেক মা-বাবা দুর্বিষহ যাতনার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করেন। এ কারণে পরিবারের মানসিক ও সামাজিক যাতনার পাশাপাশি শিশুটিরও স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও শিক্ষা ব্যাহত হয়।
কথার স্বাভাবিক মাইলফলক
- জন্ম থেকে ৩ মাস
* আনন্দ বা খুশি প্রকাশের ধ্বনি উচ্চারণ করে।
* কাউকে দেখে হাসে বা কাঁদে। - ৪ থেকে ৬ মাস
* বু-বু-বু-বু শব্দ করে।
* একাকী অথবা খুশির সময় ঘড় ঘড় শব্দ করে।
- ৭ মাস থেকে ১ বছর
* বাবা-বা-বা; ডাডা-ডা-ডা (ব্যঞ্জন শব্দ) ডাকে।
* একটি বা দুটি বুদ্ধিবৃত্তিক শব্দ, যেমন বাই-বাই, দাদা, মামা বলে। - ১ থেকে ২ বছর
* প্রতি মাসেই অতিরিক্ত বুদ্ধিবৃত্তিক শব্দ বলে।
* দুটি শব্দের সমন্বয় ঘটিয়ে কথা বলে।
* যেমন পানি খাব, মা আসো ইত্যাদি। - ২ থেকে ৩ বছর
* মোটামুটি কাছের সবকিছুর শব্দ বলতে পারে।
* দুই থেকে তিন শব্দের সমন্বয়ে বাক্য বলতে পারে এবং প্রশ্ন করতে পারে।
কখন উদ্বিগ্ন হবেন
- ১৫ মাস বয়স: কমপক্ষে তিনটি বুদ্ধিবৃত্তিক শব্দ বলতে না পারা।
- ১৮ মাস বয়স: বাবাকে বাবা বলতে এবং মাকে মা বলতে না পারলে।
- ২৪ মাস বয়স: ২০ থেকে ২৫টি শব্দ না বললে।
- ৩০ মাস বয়স: দুটি শব্দের সমন্বয়ে কথা বলতে না পারলে।
- ৩৬ মাস বয়স: কোনো জিনিসের জন্য প্রশ্ন না করলে অথবা প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্নটিই বারবার উচ্চারণ করলে।
কারণ কী
কথা বলতে না পারা অথবা দেরিতে কথা বলার কারণগুলোকে তিন ভাগে বর্ণনা করা যেতে পারে।
- এক. ধ্বনি বা শব্দতরঙ্গ মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় না। এতে মস্তিষ্কের কথোপকথনের জন্য নির্ধারিত কোষগুলো উজ্জীবিত হয় না। এ কারণে বাচ্চা কথা বলতে পারে না অথবা দেরিতে কথা বলে। শ্রবণত্রুটির কারণ হলো সেরিব্রাল পালসি।
- দুই. ধ্বনি বা শব্দ উচ্চারণে ব্যবহৃত অঙ্গের (যেমন মুখ, জিহ্বা, তালু, স্বরনালি, ফুসফুস ইত্যাদি) গঠনগত অথবা প্রায়োগিক ত্রুটির কারণে কথা বলার সমস্যা হতে পারে। যেমন ঠোঁট কাটা, তালু কাটা, সেরিব্রাল পালসি ইত্যাদি।
- তিন. ধ্বনি বা শব্দ বিশ্লেষণে মস্তিষ্কের যে স্নায়ুগুলো দায়ী, সেই স্নায়ুগুলোর বৃদ্ধি ও পরিপক্বতার অভাবে অথবা প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার কারণে কথা বলা পিছিয়ে যেতে পারে। যেমন অটিজম, মানসিক প্রতিবন্ধকতা, ক্রোমোজমের ত্রুটি ইত্যাদি।
পরীক্ষা
- ১. শ্রবণত্রুটি বের করার জন্য এওডিওমেট্রি
- ২. এমআরআই/সিটি স্ক্যান
- ৩. ইইজি
- ৪. টর্চ স্ক্রিনিং
করণীয়
স্বাভাবিক দেরির ক্ষেত্রে মা-বাবাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আপনার বাচ্চা নিকট ভবিষ্যতে বয়সানুপাতিক কথা বলবে।
বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে চিকিৎসার পদ্ধতি নির্ধারণ করা উচিত। শ্রবণত্রুটির জন্য নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। ধ্বনি উচ্চারণে অঙ্গের কোনো গঠনগত ত্রুটি থাকলে তা সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া বাক্প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ধরনের স্কুল রয়েছে, সেখানে পাঠানো যেতে পারে। সর্বোপরি স্পিচ থেরাপিস্টের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কোনো বাচ্চার স্পিচ থেরাপি দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
স্পিচ থেরাপির কিছু টিপস
- চারপাশের পরিবেশটি ধ্বনি বা শব্দ উচ্চারণের পক্ষে যেন সহায়ক হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
- শিশুর সঙ্গে সহজ, সরল ও পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলতে হবে।
- শিশুকে বিভিন্ন ধরনের সরল প্রশ্ন করতে হবে।
- খেলাধুলার বিভিন্ন সামগ্রীর সমাবেশ ঘটিয়ে প্লে থেরাপি দিতে হবে।
- বেলুন ফোলাতে দিতে হবে।
- নল (স্ট্র) দিয়ে পানি পান করাতে হবে।
- চোখে চোখে রেখে কথা বলতে হবে।
- নিয়মিত ধৈর্য ধরে পড়াতে হবে।
- ধৈর্যধারণ করে যতটুকু উন্নতি হয়, তার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
—ডা. মো. শওকত আলী
সহকারী অধ্যাপক, খুলনা মেডিকেল কলেজ, খুলনা।
Discussion about this post