এম জসীম উদ্দিন
গ্রীষ্মের গরম শুরু হওয়ার পর রাজধানী ঢাকার মতো বরিশাল বিভাগেও ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগী উপচে পড়ছে। শয্যা খালি না থাকায় কোথাও কোথাও রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু ও নারী। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় চলতি মার্চ মাসের ২৫ দিনে এই বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮১০ জন। ১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮২১ জন। তবে বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, পরিস্থিতি এখনো এতটা অস্বাভাবিক নয়। তবে উদ্বেগজনক। পরিস্থিতি সামাল দিতে আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
বরিশাল জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, চলতি মার্চ মাসের প্রথম থেকেই এই হাসপাতালে ডায়রিয়া রোগীদের চাপ বাড়তে শুরু করে। ২০ থেকে ২৪ মার্চ এই পাঁচ দিনে এই হাসপাতালে ৫০ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ সামসুন্নাহার বলেন, ডায়রিয়া রোগীর মধ্যে নারী ও শিশুদের সংখ্যাই বেশি।
কয়েকজন রোগী ও রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অবস্থা জটিল না হলে হাসপাতালমুখী হচ্ছে না ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা। বেশির ভাগই বাড়িতে বসে গ্রাম্য চিকিৎসকের চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় প্রায় ঘরে ঘরে এমন অনেক রোগী আছে বলে বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বরিশাল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া শম্পা আক্তার ও জাহিদ হোসেন বলেন, গরমে হঠাৎ পেটে ব্যথা ও পাতলা পায়খানা শুরু হয়। পরে হাসপাতালে ভর্তি হন তাঁরা। তবে গ্রামে আক্রান্ত অনেকেই বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হিজলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, এই উপজেলায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে ডায়রিয়া রোগী বেড়েছে। এর মধ্যে শিশুই বেশি। গত বুধবার এ হাসপাতালে পাঁচজন ডায়রিয়া রোগী আসে। বৃহস্পতিবার আসে ১৫ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সাহারাজ হায়াত বলেন, এ মাসে ডায়রিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশুই বেশি। এরপরই রয়েছেন নারীরা।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে শুক্রবার সন্ধ্যায় গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যাসংখ্যার চেয়ে রোগী বেশি। শয্যা আছে ১৩টি, রোগী ভর্তি ২৩ জন। বাকি রোগী মেঝেতে শয্যা চিকিৎসা নিচ্ছে। এই ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্স বলেন, প্রতিদিনই রোগী বাড়ছে।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডেই কথা হয় বরগুনা সদরের বদরখালী গ্রামের শিশু ফাতিমা (২) ও মাইঠা গ্রামের শিশু মোহাম্মদ উল্লাহর (২) স্বজনদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, গ্রামের ঘরে ঘরে শিশুরা এবং বয়স্ক লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। গুরুতর না হলে কেউ হাসপাতালে আসছেন না। হাসপাতালেও শয্যা কম, তাই মেঝেতে শয্যা নিয়ে বাচ্চাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
জেলার আমতলী উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি। উপজেলার হাসপাতালে শুক্রবার পর্যন্ত এক সপ্তাহে ডায়রিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫০ জন। এর মধ্যে শুক্রবার পর্যন্ত ২০ জন চিকিৎসাধীন আছেন। ১০ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে রোগীরা শয্যা নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন করে রোগী আসছে। এদের বেশির ভাগই শিশু। শিশু হিরামনের মা স্বর্ণা, আবু বকরের মা রাশিদা বেগম, ইকফার বাবা ইলিয়াস ও আলিফের বাবা বেলাল বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের হাসপাতাল থেকে শুধু স্যালাইন ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হচ্ছে না।
এ বিষয়ে আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা সুমন খন্দকার বলেন, ঋতু পরিবর্তনের কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। এ ডায়রিয়া সামাল দিতে পর্যাপ্ত আইভি স্যালাইন রয়েছে। রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরও এই বিভাগে ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে হানা দিয়েছিল। মৃত্যুর সংখ্যাও ছিল অস্বাভাবিক। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১০ মে পর্যন্ত বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল ৫০ হাজার ৮২০ জন। এর মধ্যে ৫২ শতাংশের বেশি রোগী আক্রান্ত হয়েছিল এপ্রিল মাসে। আর মে মাসের ১০ দিনে আক্রান্ত হয়েছিল প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ এপ্রিল থেকে ১০ মে—৪০ দিনেই আক্রান্ত হয়েছিল ৬২ শতাংশ রোগী। ডায়রিয়ায় মারা যাওয়া রোগীদের সবার মৃত্যু হয়েছে এই ৪০ দিনেই।
সরকারি হিসাবমতে, গত বছর বিভাগে ডায়রিয়ায় মারা যায় ১৯ জন। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের হিসাবে এই সংখ্যা ৩৬। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ কেউ বলছেন, দুই যুগেও এত লোকের ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর ইতিহাস নেই।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, চৈত্র-বৈশাখে পানিবাহিত এ রোগটির প্রকোপ দেখা দেয়। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে নদী-খালের পানি ব্যবহারকারীরা ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়। গত বছর স্মরণকালের ভয়াবহ ডায়রিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। এবার রাজধানীতে যে হারে বাড়ছে, এই অঞ্চলে তেমন ব্যাপকতা পায়নি। তবে যেভাবে বাড়ছে, তা উদ্বেগজনক।
Discussion about this post