হার্টবিট ডেস্ক
দেশে গত এক বছরে (২০২১ সাল) সর্বোচ্চ যক্ষ্মা রোগী ৮০ হাজার ১৩৭ জন শনাক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগে এবং সর্বনিম্ন ১৯ হাজার ৪৭ জন শনাক্ত হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগে।
অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের বিভাগগুলোর মধ্যে বরিশালে ২১ হাজার ৪৮১, চট্টগ্রামে ৬০ হাজার ২২, ঢাকায় ৮০ হাজার ১৩৭, খুলনায় ৩৯ হাজার ৭৯৬, ময়মনসিংহে ১৯ হাজার ৪৭, রাজশাহীতে ২৯ হাজার ৩৩৫, রংপুরে ৩১ হাজার ৭০৮ ও সিলেটে ২৫ হাজার ৯১৮ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে নতুন মোট ৩ লাখ ৭ হাজার ৪৪৪ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে যক্ষ্মা রোগে আনুমানিক মৃত্যু ছিল প্রতি লাখে ৫৪ জন, যা ২০২০ সালে কমে প্রতি লাখে ২৭ জনে এসে দাঁড়িয়েছে।
চিকিৎসা নিরাময়ের হার গত ১০ বছর যাবত ৯৫ শতাংশের বেশি, যা ২০২১ সালে ছিল ৯৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০২১ সালে যক্ষ্মার উপসর্গ আছে এমন প্রায় ২৮ লাখের বেশি লোকের পরীক্ষা করা হয়েছে। গত দশকে প্রায় ১০ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল টিবি রিপোর্ট-২০২০ অনুযায়ী, ২০২০ সালে সকল প্রকার যক্ষ্মা রোগীর অনুমিত সংখ্যা ৩ লাখ ৬০ হাজার জন। তবে, ওই বছরে সকল প্রকার শনাক্তকৃত যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজার ৮৮০ জন। বছরটিতে যক্ষ্মায় মৃত্যুর অনুমিত সংখ্যা ৪৪ হাজার। এবং ২০২০ সালে নতুন এমডিআর টিবি রোগীর অনুমিত সংখ্যা তিন হাজার ১০০ জন।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে আজ (২৪ মার্চ) পালিত হচ্ছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এবারের বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘বিনিয়োগ করি যক্ষ্মা নির্মূলে, জীবন বাঁচাই সবাই মিলে’। যক্ষ্মা রোগের ক্ষতিকর দিক বিশেষ করে স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই রোগ নির্মূলে বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. খুরশীদ আলম জানান, যক্ষ্মা একটি সংক্রামক রোগ, যা মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলসিস নামক অতি সূক্ষ্ম জীবাণুর মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। প্রধানত ফুসফুসই যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়; এ রকমের যক্ষ্মাকে ফুসফুসের যক্ষ্মা বলে। যক্ষ্মার জীবাণু দেহের অন্য অংশকেও আক্রান্ত করতে পারে; এই ধরনের যক্ষ্মাকে ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা বলে।
তিনি জানান, ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর কফ, হাঁচি, কাশি ও কথা বলার মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু পরিবেশে ছড়ায়। উক্ত জীবাণু বায়ুতে ভাসতে থাকে। ভাসমান জীবাণু সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করে যক্ষ্মা রোগের বিস্তার ঘটায়। বিশেষ করে ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের নিকটবর্তী পরিবারের সদস্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যক্ষ্মা সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিবারের সবাইকে সময়মত যক্ষ্মা পরীক্ষা করানো উচিত।
যক্ষ্মা প্রতিরোধের করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগী কিংবা কফে যক্ষ্মার জীবাণুযুক্ত ব্যক্তি যদি বিনা চিকিৎসায় থাকে, তবে বছরে প্রায় ১০ থেকে ১৫ জন লোককে যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত করে। তবে, জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত সকল ব্যক্তিই যক্ষ্মা রোগে ভোগে না। যে সমস্ত ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাই প্রধানত যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই, প্রতিটি যক্ষ্মা রোগীর দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পন্ন করা যক্ষ্মা প্রতিরোধের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অগ্রগতি-
যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ের জন্য বাংলাদেশে উন্নত ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন- জিন এক্সপার্ট মেশিন, এলইডি মাইক্রোস্কোপি, লিকুইড কালচার, এলপিএ, ডিজিটাল এক্সরে, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় অন্যান্য সহযোগী সংস্থার সহায়তায় সারাদেশে সরবরাহ করা হয়েছে। জিনএক্সপার্ট ৪৯০টি, যার মধ্যে করোনাকালীন সময়ে ২৩০টি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও মাইক্রোস্কোপ এক হাজার ১১৯টি ও ডিজিটাল এক্সরে স্থাপন হয়েছে ১৭৮টি। এসব পদ্ধতিতে ড্রাগ সেনসিটিভ ও ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট উভয় প্রকার যক্ষ্মার প্রায় ৮৩ শতাংশ রোগী শনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে।
এছাড়াও একটি ন্যাশনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরি ও ৫টি রিজিওনাল রেফারেন্স ল্যাবরেটরির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করা হয়।
সরকারি ৪৪টি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক, ৭টি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সদর হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তবিভাগ ও বহির্বিভাগ এবং এনজিও ক্লিনিকে যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা করা হয়।
যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় পরবর্তী প্রতিটি রোগীকে বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহের পাশাপাশি নিয়মিত ওষুধ সেবন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি রোগীর সাথে একজন ডটস্ প্রোভাইডার নিশ্চিত করা হয়েছে। যার ফলে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যুহার কমে এসেছে এবং চিকিৎসার সাফল্যের হার বেড়েছে, যা ২০০৫ সাল থেকে ৯৫ শতাংশের বেশি এবং বর্তমানে ৯৫ দশমিক ২৮ শতাংশ যা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। এ সাফল্যের কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার হার ও কমে এসেছে (বর্তমান অনুমিত সংখ্যা তিন হাজার ১০০)।
ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসা সংক্ষিপ্ত সময়ের ৯ মাস ব্যাপী রেজিমেন বাংলাদেশে সফলভাবে শুরু হয়েছে। এর ফলে চিকিৎসা ব্যয় এক চতুর্থাংশ কমে এসেছে। ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসা ব্যবস্থা উদ্ভাবনে বাংলাদেশের এ সাফল্য বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত যা ‘বাংলাদেশ রেজিমেন’ নামে স্বীকৃত। বিশ্বের অনেক দেশ এ রেজিমেন গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসায় সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত নতুন ওষুধ বেডাকুইলিন (Bedaquiline) ও ডেলামানিড (Delamanid) ব্যবহার করা হচ্ছে।
অতিসম্প্রতি ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসায় (ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর লক্ষ্যে) বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশক্রমে ইনজেকশনের পরিবর্তে মুখে ওষুধ খাওয়ানোর নতুন গাইডলাইন বাস্তবায়ন করছে, যা যক্ষ্মা ব্যবস্থাপনায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২১ সালে ২৫ হাজার শিশু ও ১২ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ককে টিবি প্রতিরোধী থেরাপি প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বিনামূল্যে রোগ শনাক্তকরণ ও ওষুধ সরবরাহ ছাড়াও দরিদ্র রোগীদের সাইকো কাউন্সিলিং ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে।
বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সাল থেকে যক্ষ্মা চিকিৎসার প্রথম সারির ওষুধ সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ক্রয় করছে। শহরাঞ্চলে বস্তি এলাকায়, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মাঝে, গার্মেন্টসে কর্মরত শ্রমিকদের, জেলখানায় ও দুর্গম এলাকায় বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ কর্মসূচিকে বেগবান করার জন্য জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও ব্র্যাক যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মোবাইল ভ্যান (জিনএক্সপার্ট ও ডিজিটাল এক্সরে সম্বলিত) কর্মসূচি।
কক্সবাজার, উখিয়া ও ভাসানচর এলাকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝেও যক্ষ্মা কর্মসূচি সম্প্রসারিত করা হয়েছে। করোনার সময়ে যুগপৎভাবে যক্ষ্মা ও কোভিড শনাক্তকরণ করা হয়েছে।
তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে জনগণকে সচেতন করার জন্য জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং বে-সরকারি সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরনের সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণকে যক্ষ্মা ও যক্ষ্মার সেবা সম্পর্কিত সাধারণ তথ্যগুলো জানানো হয়। মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য এনজিওগুলোর রয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবিকা, যারা স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের যক্ষ্মা বিষয়ক সভায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা যক্ষ্মা নির্মূলের লক্ষ্যে যে সুপারিশ সমূহ ও সাহসী লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় মুজিববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বছরব্যাপী যক্ষ্মা বিষয়ক জনসচেতনামূলক কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়েছে। যার প্রধানতম উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান করোনার সময়ে যক্ষ্মা বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জনগণকে সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণ ও যক্ষ্মা কার্যক্রমের অর্জনগুলো অব্যাহত রাখা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিনামূল্যে যক্ষ্মা রোগী শনাক্তকরণ ও তাদের চিকিৎসা সেবার আওতায় নিয়ে এসে ২০৩৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা মুক্ত বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, একজন যক্ষ্মা রোগী থেকে কমপক্ষে ছয় জনে রোগটি ছড়াতে পারে। তাই কোথাও একজন যক্ষ্মা রোগী পাওয়া গেলে তার সম্পৃক্ত কমপক্ষে ছয়জনকেই পরীক্ষা করাতে হবে।
সামিউল ইসলাম বলেন, যক্ষ্মা শনাক্তকরণই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। যক্ষ্মায় চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯৬ শতাংশ সাফল্য এসেছে। জটিল যক্ষ্মা রোগ নির্ণয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ১০০ উপজেলায় ডিজিটাল এক্সরে স্থাপন করা হবে।
প্রসঙ্গত, ১৮৮২ সালে ২৪ মার্চ ডা. রবার্ট করু যক্ষ্মা রোগের জীবাণু মাইক্রোব্যাটেরিয়াম টিউবারকিউলসিস আবিষ্কার করেন। জীবাণু আবিষ্কারের ১০০ বছর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জীবাণু আবিষ্কারের দিনটিকে স্মরণীয় করা ও যক্ষ্মারোগের চিকিৎসা সম্পর্কে গণসচেতনা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর এই দিনটিকে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস পালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছরও সারা বিশ্বে এই দিনটি উদযাপিত হবে।
জানা গেছে, যক্ষ্মা এখনো বিশ্বের ১০টি মৃত্যুজনিত কারণের মধ্যে অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতিদিন বিশ্বে চার হাজার মানুষ যক্ষ্মা রোগে মারা যান এবং ৩০ হাজার আক্রান্ত হন। তবে বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় ২০০০ সাল থেকে ৫৮ মিলিয়ন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে।
Discussion about this post