হার্টবিট ডেস্ক
সারা বিশ্বে বর্তমানে ৪৬ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশে আক্রান্ত ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা ৮৬ লাখেরও বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার মূল কারণ আবিষ্কারের দাবি করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মধু এস মালো ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খানের নেতৃত্বে এক দল গবেষক।
বুধবার (২৩ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন অধ্যাপক মধু এস মালো।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল ও সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে গত পাঁচ বছর ধরে ৩০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৫৭৪ জন সুস্থ লোকের ওপর এই গবেষণা পরিচালনা করা হয়।
উল্লেখ্য, গত কয়েক দশক ধরে অন্যান্য গবেষকরা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, ডায়াবেটিসের প্রত্যক্ষ কারণ হলো টক্সিন-নিয়ন্ত্রিত নিম্ন গ্রেডের সিস্টেমিক প্রদাহ। যার ফলে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন ইনসুলিনের উৎপাদন ও কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস হয়।
মধু এস মালো জানান, মানবদেহের অন্ত্রে থাকা মৃত ব্যাকটেরিয়ার কোষ-প্রাচীরের অংশ টক্সিন (এডোটক্সিন) হিসেবে কাজ করে। এই টক্সিন সাধারণত মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। তবে, উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার, ফ্রুকটোজ বা অ্যালকোহল টক্সিনতে রক্তে ঢুকতে সহায়তা করে। এর ফলে নিম্ন গ্রেডের সিসটেমিক প্রদাহের সৃষ্টি হয়। যার ফলে ডায়াবেটিস হতে পারে।
তিনি জানান, মানবদেহের অন্ত্রে থাকা ইন্টেস্টিনাইল আলকালাইন ফসফাটেস নামক এনজাইম এই টক্সিনকে ধ্বংস করে দেয়। এ এনজাইমের ঘাটতি হলে অন্ত্রে অতিরিক্ত টক্সিন জমা হয়। এই টক্সিন রক্তে ঢুকে সিসটেমিক প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে একদিকে যেমন ডায়াবেটিস হতে পারে তেমনি ইশকেমিক হার্ট ডিজিজও হতে পারে (কেননা ইশকেমিক হার্ট ডিজিজেরও অন্যতম কারণ সিসটেমিক প্রদাহ)।
ড. মধু বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, মোটা হলেই ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। কিন্তু মূলত ডায়াবেটিসের সঙ্গে মোটা হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। যাদের আইএপি লেভেল বেশি, তাদের ঝুঁকি কম। আবার যাদের আইএপি কম, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি। দেহে আইএপি কম হলে হার্ট ডিজিজও হতে পারে। কোলেস্টেরল বেড়ে যায়।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ বলেন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কারণই হলো আইএপি লেভেল বেড়ে যাওয়া। এছাড়াও মুটিয়ে যাওয়া, শারীরিক অ্যাক্টিভিটি কমে যাওয়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হওয়া অন্যতম।
তিনি আরও বলেন, দেশে ১৫ শতাংশ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে জেনেটিক কারণে। যেগুলো রোধে আমাদের কিছুই করার নেই। তবে, বাকি ৮৫ শতাংশই আইএপি সংক্রান্ত কারণে হয়ে থাকে।
গবেষণায় দেখা যায়, যাদের শরীরে এ এনজাইম বেশি থাকে তাদের তুলনায় যাদের কম থাকে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার হার ১৩ দশমিক ৮ গুণ বেশি। অল্পবয়সীদের যাদের অন্ত্রে এ এনজাইমটি দ্রুত কমতে থাকে তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৭ দশমিক ৩ গুণ বেশি।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যাদের অন্ত্রে এ এনজাইমটি কম ছিল এবং পরে বেড়েছে তাদের ডায়াবেটিস হয়নি। এনজাইমটি যাদের অন্ত্রে কম ছিল তাদের ফাস্টিং সুগার বৃদ্ধির মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ। এনজাইমের মাত্রা বেশি হলে স্থূল ব্যক্তিদের ডায়াবেটিস হয় না।
গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, যাদের দেহে এ এনজাইমের পরিমাণ কম তাদেরকে এনজাইম খাওয়ানো সম্ভব হলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। বর্তমানে গবেষকরা এনজাইমটি তৈরির চেষ্টা করছেন।
গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ও আমেরিকান ডায়াবেটিস সমিতির যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত জার্নাল ‘দি বিএমজে ওপেন ডায়াবেটিস রিসার্চ অ্যান্ড কেয়ার’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক মধু এস মালো এর আগে মানবদেহে থাকা ইন্টেস্টিনাইল আলকালাইন ফসফাটেস নামক এনজাইম পরিমাপের লক্ষ্যে স্কুলভিত্তিক টেস্ট পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এই টেস্টের মাধ্যমে এনজাইমের স্বল্পতার কারণে একজন ব্যক্তির ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি আছে কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব হবে। যাদের ঝুঁকি রয়েছে তারা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে ডায়াবেটিস হতে মুক্ত থাকতে পারবেন।
ড. মালো ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির উপদেষ্টা এবং বারডেমের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
গবেষণাটি বারডেমের প্রফেসর ফারুক পাঠান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক সালিমুর রহমান ও অধ্যাপক মুহাম্মদ হাসানাত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেকুল ইসলামের সহযোগিতায় পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণায় আরও সহযোগিতা করেছেন বাডাসের জগন্নাথ মালো, মো. মেহেদী হাসান রকি, জিনোক বর্মন, শামেমা আক্তার তিন্নি, স্বপন কে. বর্মন, তাপস সরকার, বারডেমের ড. মো. আব্দুল মোত্তালিব ও মো. নাঈমুল ইসলাম খান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম এবং ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কনকরাজু কালিযান্নান।
Discussion about this post